কিন্তু প্রশ্ন হলো—এ সংঘাতের আসল উদ্দেশ্য কী? কেন আমেরিকার মতো সুপারপাওয়ারও থামাতে পারছে না এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে? আর হুতিদের প্রতিরোধ কি কেবল ইয়েমেনের জন্য, নাকি এর পেছনে আছে বড় কোনো রাজনৈতিক বার্তা? হুতিদের সামরিক শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতি, ইরানের ভূমিকা এবং এই সংঘাতের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাবের বিশ্লেষণ থাকছে এ প্রতিবেদনে।
অভিযোগ উঠেছে, মার্কিন বাহিনী এখন আর কেবল হুতি সামরিক কাঠামোকে নয়, বরং বেসামরিক পরিকাঠামোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এই হামলার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে এটিকে ‘অপারেশন রাফ রাইডার’-এর অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হতি বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ২১৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৪৩৬ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে এ অভিযানের বাস্তব প্রভাব নিয়ে। হুতিরা এখনো প্রতিদিনই ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে যাচ্ছে মার্কিন ও ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর দিকে। লোহিত সাগরে মার্কিন নৌবহর যেমন ইউএসএস ট্রুম্যান এবং বাণিজ্যিক জাহাজ আজও হুতিদের টার্গেট হচ্ছে।
ধারাবাহিক হামলায় সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান লোহিত সাগর থেকে সরে উত্তর দিকের নিরাপদ অঞ্চলের দিকে পিছু হটেছে।
সেন্টকম স্বীকার করেছে, এই অভিযানের পর হুতিদের হামলার কার্যকারিতা কিছুটা কমেছে—ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ৬৯ শতাংশ এবং একমুখী ড্রোন হামলা ৫৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে একইসঙ্গে এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের থামাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
হুতি আন্দোলন এখন আর শুধু একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী নয়, বরং তা ক্রমেই একটি সংগঠিত প্রতিরোধ শক্তিতে রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি তারা ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায়, বিশেষত নেভাতিম বিমানঘাঁটিতে, হাইপারসোনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করেছে।
হুতি আন্দোলনের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারে স্পষ্ট বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হুতিদের সামরিক প্রতিরোধ চলবে। তারা এই বক্তব্যে প্রমাণ করে তারা কেবল কেবল ইয়েমেনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তারা এখন ফিলিস্তিনের পক্ষেও সক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
হুতিদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত এড়াতে রণতরীটি আকস্মিকভাবে বাঁক নেয়, তখন যুদ্ধবিমানটি সাগরে পড়ে যায়। এ ছাড়া মার্চের মাঝামাঝি থেকে সাতটি এমকিউ-৯ র্যাপার ড্রোন হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, প্রতিটির দাম প্রায় তিন কোটি ডলার
এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র শুধু আগ্রাসী ভূমিকায় নেই, বরং তাদের ক্ষয়ক্ষতির পাল্টা খতিয়ানও দীর্ঘ হচ্ছে। ২৯ এপ্রিল সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানায়, ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান রণতরী থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট যুদ্ধবিমান সাগরে পড়ে গেছে। বিমানটির মূল্য প্রায় ৬৭ কোটি ডলার।
মার্কিন এক কর্মকর্তা বলেন, হুতিদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত এড়াতে রণতরীটি আকস্মিকভাবে বাঁক নেয়, তখন যুদ্ধবিমানটি সাগরে পড়ে যায়। এ ছাড়া মার্চের মাঝামাঝি থেকে সাতটি এমকিউ-৯ র্যাপার ড্রোন হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, প্রতিটির দাম প্রায় তিন কোটি ডলার।
বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়; বরং যুদ্ধক্ষেত্রে হুতিদের প্রযুক্তিগত উন্নতি ও মার্কিন প্রস্তুতির দুর্বলতা স্পষ্ট করে দেয়।
এই সংঘাত এখন আর কেবল মার্কিন-হুতি বা ইসরায়েল-হুতি যুদ্ধ নয়, বরং তা লোহিত সাগর ও আন্দামান উপসাগরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশ্বের ১২ শতাংশ বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল হয় এই জলপথ দিয়ে। হুতিদের হামলা সরাসরি বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলছে—বিশেষত ইউরোপ-এশিয়া বাণিজ্যে।
এই অঞ্চলে বাণিজ্য জাহাজ নিরাপদ রাখতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ একাধিক দেশ নৌ টহল বাড়িয়েছে, কিন্তু হুতিরা এসব নৌবহরের সামনেই সাহসিকতার সঙ্গে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

সেন্টকম বারবার ইঙ্গিত করছে, হুতিদের এ প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে ইরানের সরাসরি সহায়তায়। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, ড্রোন প্রস্তুতি ও যুদ্ধ পরিকল্পনায় তেহরানের প্রশিক্ষণ ও রসদ সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
পশ্চিমা দেশগুলো হুতিদের কার্যক্রমকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিলেও, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মানুষ ও সংগঠন হুতিদের ‘প্রতিরোধের প্রতীক’ হিসেবে দেখছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা, গাজায় গণহত্যা ও আরব রাষ্ট্রগুলোর নিরবতার প্রেক্ষাপটে হুতিদের আঘাত অনেকের কাছে ‘ন্যায্য প্রতিক্রিয়া’ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
তবে এটাও সত্য যে হুতিদের হামলায় মাঝে মাঝে বেসামরিক মানুষ, জাহাজ বা অবাণিজ্যিক স্থাপনাও আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে তাদের প্রতিরোধকে কেউ কেউ অন্ধ প্রতিশোধ হিসেবেও দেখছেন।
মার্কিন হামলা থেমে নেই, হুতিদের প্রতিরোধও থেমে নেই। বরং সংঘাতের গভীরতা ও পরিধি দুটোই বাড়ছে। হুতিদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ছে, তারা নতুন নতুন অস্ত্র ব্যবহার করছে, এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি পুনর্গঠিত হচ্ছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত যদি কূটনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে এটি শুধু ইয়েমেন বা লোহিত সাগর নয়—বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে ফেলবে।