দেশের তথ্য ডেস্ক।। রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা গেছেন সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী/ বৃষ্টি খাতুন। লাশ নিতে এসে বিপাকে পড়েছেন তার বাবা শাবলুল আলম সবুজ। লাশ নিতে এসে সমস্ত কাগজপত্র প্রমাণ হিসেবে দিলে ওই তরুণীর জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজে প্রবেশপত্র এবং চাকরির জন্মবৃত্তান্তে নামের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন গরমিল পাওয়া গেছে।
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে নিহত সাংবাদিকের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ায় তার লাশ হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।
ওই সাংবাদিককে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে চিনতেন তার সহকর্মীরা; ফেসবুকেও তার ওই নাম পাওয়া যায়। মন্দিরে গিয়ে নিয়মিত পূজা-অর্চনাও করতেন তিনি।
তার মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ছুটে আসা তার বাবা শাবলুল আলম সবুজ বলছেন, তার মেয়ের নাম বৃষ্টি খাতুন।
অভিশ্রুতি কাজ করতেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ নামের একটি নিউজ পোর্টালে। সম্প্রতি সেই চাকরি ছেড়ে দেন, তার যোগ দেওয়ার কথা ছিল আরেকটি সংবাদমাধ্যমে।
রিপোর্ট ডট লাইভ ছেড়ে সম্প্রতি কেস্টারটেক নামে একটি অনলাইন মাল্টিমিডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেওয়া তুষার হাওলাদারের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন অভিশ্রুতি। ওই ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ গেছে মোট ৪৬ জনের। অভিশ্রুতি আর তুষারও রয়েছেন তাদের মধ্যে।
লাশ গ্রহণ করতে এসে শাবলুল আলম সবুজ বলেন, অভিশ্রুতি আমার মেয়ে। ওর জন্ম ২৫ ডিসেম্বর মনে হয়। আমার মেয়ে।
তিনি বলেন, ওর ডাক নাম বৃষ্টি খাতুন। গ্রামে নাম বৃষ্টি, স্কুলে নাম বৃষ্টি, কুষ্টিয়া গভর্নমেন্ট মহিলা কলেজে যখন পড়েছে, তখনো বৃষ্টি, ঢাকাতে যখন ভর্তি হয়েছে ইডেন কলেজে, ঢাবি সাত কলেজের অধীনে, তখনো বৃষ্টি, দর্শনে পড়াশোনা করে রোল নম্বর ২৭৬, তখনো বৃষ্টি।
মন্দিরে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এতটুকু জানি, ও বন্ধুবান্ধবের সাথে মন্দিরে যায় মাঝেমাঝে, চলাফেরা করে। সেই এতটুকু আমাদের সাথে কথাবার্তা বলে। তা ছাড়া অতিরিক্ত কিছু আমরা জানি না।
রমনা কালীমন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা বলছেন, নিয়মিত মন্দিরে এসে হিন্দু ধর্ম চর্চা ও পূজা-অর্চনা করতেন ওই নারী সাংবাদিক।
তিনি বলেন, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী হিসাবে, সে ব্রাহ্মণ মেয়ে– সে হিসাবে এখানে পরিচয় দিত। ধর্মীয় কৃষ্টি কালচারগুলো আমাদের সাথে পালন করেছে। আমরা চাই, এ বিষয়টির একটা সমাধানের জায়গায় আসুক… তার পিতৃ পরিচয়। আমার কথা হচ্ছে— সে যে ধর্মেরই হোক, সে হিন্দু ধর্মের সেটা আমি বলতে চাচ্ছি না; বা মুসলিম ধর্মের, সেটিও পরীক্ষার বিষয় আছে, তদন্তের বিষয় আছে। সেই তদন্ত হোক।
তিনি আরও বলেন, যদি সে হিন্দু হয়ে থাকে, তবে তাকে সেই কালচারেই আমরা আমাদের যে মন্দির, আমাদের সাথে যেহেতু কানেকশন ছিল তার এবং পূজা-অর্চনা করত। সে হিসাবে আমাদের এই প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মকানুন বজায় রেখে, আমাদের হিন্দু ধর্মীয় মতে শেষকৃত্যটা করতে চাই।
কাগজপত্রে গরমিল
অভিশ্রুতি বা বৃষ্টির জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং চাকরির জন্মবৃত্তান্তে বাবা-মায়ের নামে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া গেছে। তবে স্থায়ী ঠিকানা সব জায়গায় একই।
২০২১ সালের ৬ জুলাই ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম বৃষ্টি খাতুন হিসাবেই রয়েছে। সেখানে পিতার নাম সবুজ শেখ এবং মাতার নাম বিউটি বেগম। কলেজের প্রবেশপত্রেও তার একই রকম তথ্য আছে।
২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর ইস্যু করা জন্ম নিবন্ধন সনদে আছে নাম অভিশ্রুতি লেখা হলেও বাবার নাম লেখা হয়েছে মো. সাবুরুল আলম এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম।
অন্যদিকে চাকরির জন্মবৃত্তান্তে নিজের নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী লিখেছেন তিনি। তবে বাবার নাম লেখা হয়েছে সাবুরুল আলম এবং মায়ের নাম অপর্ণা শাস্ত্রী।
জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং জন্মবৃত্তান্তে জন্ম তারিখ ২০০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর রয়েছে। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৮।
অভিশ্রুতির সাবেক কর্মস্থল দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের চিফ রিপোর্টার গোলাম রাব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, চাকরির বায়োডাটায় তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। সবুজ শেখই অভিশ্রুতির বাবা এবং বিউটি বেগমই তার মা।
তিনি বলেন, অভিশ্রুতি হিন্দু ধর্ম চর্চা করতেন বলেই আমরা দেখেছি। নিয়মিত পূজা-অর্চনা করতে মন্দিরে যেতেন। জন্ম নিবন্ধনে তিনি নাম পরিবর্তনও করেছেন। ধর্ম পরিবর্তনের চেষ্টায় থাকতে পারেন হয়তো।
অভিশ্রুতির বাবা বলেন, আমরা মুসলমান। এক সপ্তাহ আগে বলেছি, বাবা বাড়ি যাবা? বলেছে, না একেবারে ঈদে বাড়ি যাব।
সবশেষ কয়দিন আগে কথা হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিন থেকে চারদিন হতে পারে। চারদিন মনে হয়।
জুমার নামাজের পর অভিশ্রুতির এক বান্ধবীর ফোনে তার মৃত্যুর খবর জানার কথা বলেন শাবলুল আলম সবুজ।
নাম পরিবর্তন বা ধর্ম পরিবর্তন করেছে কিনা— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না, ধর্ম পরিবর্তনের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো হদিস নাই। আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নাই যে, ধর্ম পরিবর্তন করছে, নাম পরিবর্তন করছে আমরা জানি না।
এক প্রশ্নে সবুজ বলেন, এক বছর আগে আমি একবার শুনেছি, মন্দিরে গেছে। একজন মন্দিরে যাওয়ার ছবি দেখিয়েছে। তখন আমাকে জানাইছে।
তিনি বলেন, হিন্দু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চলাফেরা করে, একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছে, তাদের সঙ্গে গেছে। এটার সত্য-মিথ্যা জানি না।
মেয়ের সঙ্গে দূরত্ব ছিল কিনা– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নাই, হিংসা নাই। মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে, টাকাপয়সা লাগলে নিত। অনেক সময় বাজারও নিয়ে আসত।
ভারতের বেনারস থেকে অভিশ্রুতির ‘ঘটনাচক্রে’ বাংলাদেশে আসার কথা বলছেন রমনা কালীমন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা।
তিনি বলেন, আমাদের মন্দিরে এসে ধর্মীয় চর্চা বা পূজা অর্চনা, এই জিনিসগুলোর মাধ্যমে কিন্তু তার সাথে পরিচয়। তার পার্সোনাল বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে যতটুকু শেয়ার করেছে, সেটুকু বলি— সেটা হচ্ছে তার ফ্যামিলি বেনারসে ছিল এবং তার পিতৃ পরিচয়, বেনারসে বাবা ও মা একটি মন্দিরে সেবায়েত হিসাবে ছিল, সেই জায়গা থেকে আসছে।
তিনি আরও বলেন, তার ফাদার-মাদার ওখানে মৃত্যু বরণ করার পরে, কোনো একটা ঘটনাচক্রে, সেটি আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়নি বা সেটি বলেনি, ঘটনাচক্রে সে বাংলাদেশে কুষ্টিয়াতে এসেছে এবং এখানে সে পড়াশোনা সে মুসলিম ফ্যামিলিতে করেছে, এটুকু আমরা জানি। এটুকু আমরা শুনেছি তার কাছ থেকে।
অভিশ্রুতি অথবা বৃষ্টি খাতুন, কেন পরিচয় বদলেছিলেন তিনি?
অভিশ্রুতির ধর্ম পরিচয় নিয়ে আলোচনা চলছে ফেসবুকেও। নিজেকে অভিশ্রুতির ‘কাছের বন্ধু’ পরিচয় দেওয়া মাহফুজুর রহমান নামের একজন এক পোস্টে লিখেছেন, ধর্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্নের সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্য রয়েছে তার কাছে।
মাহফুজের ভাষ্য— ও যাদেরকে বাবা মা হিসাবে পরিচয় দিত, তারা মুসলিম হলেও ও নিজে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। কারণ তার মতে কুষ্টিয়ার সবুজ শেখ ও তার স্ত্রী মূলত তার পালক পিতামাতা, ওকে ইন্ডিয়ার কোনো একটা হিন্দু পরিবার থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল।
মাহফুজ লিখেছেন, যদিও ওর মা দৃঢ়ভাবে দাবি করতেন— ‘আমাদের পরিবারেই জন্ম নিয়েছে। ও অবশ্যই মুসলিম, ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত নামাজ পড়ত। তারপর ওর বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে’। এই নিয়ে ওর পরিবারের সাথে ওর জটিলতা চলছিল অনেক দিন ধরেই।
এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত কথা বলতে মাহফুজের ফেসবুকে দেওয়া ফোন নম্বরে কল করলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস করলেও সাড়া দেননি।
বেইলি রোডে মারা যাওয়া ৪৬ জনের মধ্যে ৪৩ জনের মরদেহ ইতোমধ্যে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তুষারের বাবা দীনেশ চন্দ্র হাওলাদারও সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছেলের লাশ বুঝে নেন। কিন্তু অভিশ্রুতি বা বৃষ্টির বাবা মর্গে গিয়ে পড়েন জটিলতায়।