Dhaka 2:39 am, Sunday, 6 July 2025

পাইকগাছায় নৌকায় জীবন যাপন ৭০ বছরের সুখেন-নমিতা দম্পতির

 

শাহরিয়ার কবির

জীবন যুদ্ধে হার না মানা সুখেন বিশ্বাস। গত ১যুগ ধরে খুলনার পাইকগাছায় কপোতাক্ষ নদের তীরে একটি নৌকায় সংসার পেতেছেন সুখেন-নমিতা দম্পতি। যতই আসুক রৌদ ঝড় বৃষ্টি তবুও নদীর কিনারে ভাসমান নৌকায় জীবন যাপন করছে এই দম্পতি। জানা যায়, গত ১যুগ পূর্বে সর্বনাশা কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে সুখেন এর পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুও হারিয়ে ফেলে।এটা কোনো বই বা সিনেমার গল্প না।এটা জীবন যুদ্ধে হার না মানা পাইকগাছার সুখেন-নমিতা দম্পতির জীবন কাহিনী।

উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের বোয়ালিয়া মালোপাড়ার পশ্চিম পাড়ে আশ্রায়ণ প্রকল্পের একটি থাকার ঘর চেয়েও ঘর না পাওয়ায় সুখেনের ডাঙ্গায় ফেরা হয়নি। তাই স্ত্রী নমিতা বিশ্বাসকে নিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছেন। সুখেনের বয়স প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি। খেয়ে না খেয়ে কোন রকম দিন পার করছে। জীবিকার প্রয়োজনে কপোতাক্ষ নদে ও শিবসা নদীর জলে জীবন চাকা ঘুরাতে মাছ ধরে। প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ নানান প্রতিকূলতার সাথে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় এই সুখেন-নমিতা দম্পতির। তবুও জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার বাসনায় স্বপ্ন বুনছেন।

কাঠের তৈরী নৌকায় জলে ভেসে ভেসে এক যুগের বেশী কাটিয়েছে সুখেন-নমিতা দম্পতি। ছোট্ট একটা নৌকাই তার ঘর-বাড়ি-সংসার। যাযাবর বা বেদে না হয়েও নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছে।সকাল দুপুর পড়ন্ত বিকেল গোধূলি শেষে সন্ধ্যা হলে সোলার লাইট এর আলোতে আলোকিত হয় নৌকার ঘরে। বিকালে চুলা জালায় নৌকায়, রাতেই হয় খাওয়া। এভাবেই বসবাস করে আসছেন ওই নদীর কিনারে থাকা সুখেন পরিবার। রাতে নদীতে জাল ফেলে সময় পেলে নৌকায় বসে আপন মনে একতারা বাজিয়ে বাউল গান গায়ে মনে দুঃখ দূর করে।এমন ভাবে তার মনের দুঃখ কিছুটা হালকা করে। আধুনিক সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়া এই দরিদ্র মালো পরিবারটি জায়গা জমি না থাকায় অসহায় হয়ে নদীতে জীবন পার করছে।

জানা যায়, পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের হিতামপুর বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদের তীরে সুখেন বিশ্বাসের জমি ঘর-বাড়ি ছিলো। কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গনে সুখেনসহ অনেকের জমি ঘর বিলিন হয়ে যায়। হত দরিদ্র সুখেন ঘর-বাড়ি হারিয়ে ভাসমান জীবন যাপন করতে থাকে। তার চার মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বিদ্যুৎ বিশ্বাস কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন।তার এক মেয়ে কপোতাক্ষ নদের চরে সরকারি জমিতে দোচালা টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যুৎ বিশ্বাস বোনের তৈরি করা ঘরের এক রুমে থাকেন। সুখেনের থাকার জায়গা না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে মাছ ধরা নৌকায় বসবাস শুরু করেন সুখেন-নমিতা দম্পতি। নৌকায় তাদের সব কিছু ঘর-বাড়ি, সংসার আবার রোজগারের একমাত্র অবলম্বন নৌকা আর জাল। বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদ থেকে শিবসা নদীর ব্রীজ পর্যন্ত ছোট জাল ফেলে মাছ ধরে সংসার চালায়।

ভাসমান জীবন যাপন করা সুখেন বিশ্বাস ও তার স্ত্রী নমিতা বিশ্বাসকে কপোতাক্ষ নদে খুজে পাওয়া যায়। তার এমন ভাসমান জীবন-যাপন নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গনে আমার জমি ঘর বিলিন হয়ে গৃহহীন হয়েছি। পরের জায়গায় এখানে সেখানে থেকেছি। গরিব মানুষ জমি কেনার টাকা নেই, তাই নিরুপায় হয়ে আমরা নৌকায় বসবাস করছি।

আম্ফান ঝড়ে আমার নৌকা নদী থেকে উঠায়ে নিয়ে দুরে ফেলে দেয়।এতে নৌকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তখন ধার দেনা করে খাই।অনেক কষ্ট করে ১৫ হাজার টাকা সুদে নিয়ে নৌকা কিনেছি। এই নৌকা দিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরি আবার নৌকায় ঘর সংসার সব কিছু।শিবসা ব্রিজের পাশে মাসের ১৫/২০ দিন মাছ ধরি। যে মাছ পাই তা বিক্রি করে চাউল ডাউল কিনে দুই জনের সংসার চালাই। রাতে নদীর পাশে গাছে নৌকার রশি বেধে ঘুমাই। ঝড়ের খবর পেলে খালের ভিতর নৌকা নিয়ে বেধে রাখি। মাঝে মাঝে বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদে এসে মেয়ের বাসায় রান্না করে নৌকায় নিয়ে খেয়ে নৌকায় ঘুমায়। নদী থেকে মাছ ধরে সে মাছ বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চলে। তিনি আরো বলেন, গুচ্ছ গ্রামে ঘর চাইছিলাম ঘর হয়নি, নৌকায় থাকতে ভয় লাগে ঝড় বৃষ্টিতে কখন কি হয়। আমাকে একটা ঘর দিলে নিশ্চিতভাবে থাকতে পারবো।

পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন জানান, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। আপনাদের কাছে জানতে পারলাম তবে তিনি প্রকৃত ভূমিহীন হলে এবং ঘরের জন্য আবেদন করলে হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে।আশ্রায়ণ কেন্দ্রের কোন ঘর খালি আছে কিনা খোজ নিতে হবে। খালি ঘর পেলে উনাকে ঘর দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হবে।

ট্যাগ :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

জনপ্রিয় সংবাদ

পাইকগাছায় নৌকায় জীবন যাপন ৭০ বছরের সুখেন-নমিতা দম্পতির

প্রকাশঃ 04:24:44 pm, Tuesday, 17 June 2025

 

শাহরিয়ার কবির

জীবন যুদ্ধে হার না মানা সুখেন বিশ্বাস। গত ১যুগ ধরে খুলনার পাইকগাছায় কপোতাক্ষ নদের তীরে একটি নৌকায় সংসার পেতেছেন সুখেন-নমিতা দম্পতি। যতই আসুক রৌদ ঝড় বৃষ্টি তবুও নদীর কিনারে ভাসমান নৌকায় জীবন যাপন করছে এই দম্পতি। জানা যায়, গত ১যুগ পূর্বে সর্বনাশা কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে সুখেন এর পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুও হারিয়ে ফেলে।এটা কোনো বই বা সিনেমার গল্প না।এটা জীবন যুদ্ধে হার না মানা পাইকগাছার সুখেন-নমিতা দম্পতির জীবন কাহিনী।

উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের বোয়ালিয়া মালোপাড়ার পশ্চিম পাড়ে আশ্রায়ণ প্রকল্পের একটি থাকার ঘর চেয়েও ঘর না পাওয়ায় সুখেনের ডাঙ্গায় ফেরা হয়নি। তাই স্ত্রী নমিতা বিশ্বাসকে নিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছেন। সুখেনের বয়স প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি। খেয়ে না খেয়ে কোন রকম দিন পার করছে। জীবিকার প্রয়োজনে কপোতাক্ষ নদে ও শিবসা নদীর জলে জীবন চাকা ঘুরাতে মাছ ধরে। প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ নানান প্রতিকূলতার সাথে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় এই সুখেন-নমিতা দম্পতির। তবুও জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার বাসনায় স্বপ্ন বুনছেন।

কাঠের তৈরী নৌকায় জলে ভেসে ভেসে এক যুগের বেশী কাটিয়েছে সুখেন-নমিতা দম্পতি। ছোট্ট একটা নৌকাই তার ঘর-বাড়ি-সংসার। যাযাবর বা বেদে না হয়েও নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছে।সকাল দুপুর পড়ন্ত বিকেল গোধূলি শেষে সন্ধ্যা হলে সোলার লাইট এর আলোতে আলোকিত হয় নৌকার ঘরে। বিকালে চুলা জালায় নৌকায়, রাতেই হয় খাওয়া। এভাবেই বসবাস করে আসছেন ওই নদীর কিনারে থাকা সুখেন পরিবার। রাতে নদীতে জাল ফেলে সময় পেলে নৌকায় বসে আপন মনে একতারা বাজিয়ে বাউল গান গায়ে মনে দুঃখ দূর করে।এমন ভাবে তার মনের দুঃখ কিছুটা হালকা করে। আধুনিক সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়া এই দরিদ্র মালো পরিবারটি জায়গা জমি না থাকায় অসহায় হয়ে নদীতে জীবন পার করছে।

জানা যায়, পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের হিতামপুর বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদের তীরে সুখেন বিশ্বাসের জমি ঘর-বাড়ি ছিলো। কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গনে সুখেনসহ অনেকের জমি ঘর বিলিন হয়ে যায়। হত দরিদ্র সুখেন ঘর-বাড়ি হারিয়ে ভাসমান জীবন যাপন করতে থাকে। তার চার মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বিদ্যুৎ বিশ্বাস কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন।তার এক মেয়ে কপোতাক্ষ নদের চরে সরকারি জমিতে দোচালা টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস করছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যুৎ বিশ্বাস বোনের তৈরি করা ঘরের এক রুমে থাকেন। সুখেনের থাকার জায়গা না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে মাছ ধরা নৌকায় বসবাস শুরু করেন সুখেন-নমিতা দম্পতি। নৌকায় তাদের সব কিছু ঘর-বাড়ি, সংসার আবার রোজগারের একমাত্র অবলম্বন নৌকা আর জাল। বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদ থেকে শিবসা নদীর ব্রীজ পর্যন্ত ছোট জাল ফেলে মাছ ধরে সংসার চালায়।

ভাসমান জীবন যাপন করা সুখেন বিশ্বাস ও তার স্ত্রী নমিতা বিশ্বাসকে কপোতাক্ষ নদে খুজে পাওয়া যায়। তার এমন ভাসমান জীবন-যাপন নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গনে আমার জমি ঘর বিলিন হয়ে গৃহহীন হয়েছি। পরের জায়গায় এখানে সেখানে থেকেছি। গরিব মানুষ জমি কেনার টাকা নেই, তাই নিরুপায় হয়ে আমরা নৌকায় বসবাস করছি।

আম্ফান ঝড়ে আমার নৌকা নদী থেকে উঠায়ে নিয়ে দুরে ফেলে দেয়।এতে নৌকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তখন ধার দেনা করে খাই।অনেক কষ্ট করে ১৫ হাজার টাকা সুদে নিয়ে নৌকা কিনেছি। এই নৌকা দিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরি আবার নৌকায় ঘর সংসার সব কিছু।শিবসা ব্রিজের পাশে মাসের ১৫/২০ দিন মাছ ধরি। যে মাছ পাই তা বিক্রি করে চাউল ডাউল কিনে দুই জনের সংসার চালাই। রাতে নদীর পাশে গাছে নৌকার রশি বেধে ঘুমাই। ঝড়ের খবর পেলে খালের ভিতর নৌকা নিয়ে বেধে রাখি। মাঝে মাঝে বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় কপোতাক্ষ নদে এসে মেয়ের বাসায় রান্না করে নৌকায় নিয়ে খেয়ে নৌকায় ঘুমায়। নদী থেকে মাছ ধরে সে মাছ বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চলে। তিনি আরো বলেন, গুচ্ছ গ্রামে ঘর চাইছিলাম ঘর হয়নি, নৌকায় থাকতে ভয় লাগে ঝড় বৃষ্টিতে কখন কি হয়। আমাকে একটা ঘর দিলে নিশ্চিতভাবে থাকতে পারবো।

পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন জানান, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। আপনাদের কাছে জানতে পারলাম তবে তিনি প্রকৃত ভূমিহীন হলে এবং ঘরের জন্য আবেদন করলে হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে।আশ্রায়ণ কেন্দ্রের কোন ঘর খালি আছে কিনা খোজ নিতে হবে। খালি ঘর পেলে উনাকে ঘর দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হবে।