মিয়ানমারের সংঘাতে কাঁপছে বাংলাদেশ সীমান্ত, নিরাপদ আশ্রয়ে বাসিন্দারা
দেশের তথ্য ডেস্ক: মিয়ানমারের ভেতরে দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই বিরতিহীন ভাবে চলছে। লাগাতার গোলাগুলি, মর্টারশেল নিক্ষেপ ও রকেট লঞ্চার বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্র“ এলাকা। গুলির অংশ ও রকেট লঞ্চারের ভগ্নাংশ উড়ে এসে পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘুমধুম-তুমব্র“ এলাকায় বসতঘরের ওপর।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন, কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন থেকে শুরু করে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় এমন শব্দ শোনা যাচ্ছে।
জানা যায়, ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকুবুনিয়া সীমান্তচৌকি চৌকি দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মধ্যে গুলি বিনিময় ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এর ফলে আতঙ্ক বেড়ে গেছে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে।
মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ে এপারে বাংলাদেশের বসতঘরে। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সীমান্তের দু’টি বসতঘরে মর্টার শেল এবং আরও পাঁচটি ঘরে গুলি এসে আঘাত হেনেছে। এতে কেউ হতাহত না হলেও নিরাপদ আশ্রয়ে সীমান্ত এলাকা ছেড়েছেন কিছু লোক।
অন্যদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্র“ সীমান্তে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলায় আরও এক বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। তাকে দ্রুত উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে আহত হওয়া ওই ব্যক্তির নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার দুপুরের দিকে উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্র“ সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজীজ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মঙ্গলবার দুপুরে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মোঃ শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, তুমব্র“ ও ঘুমধুম সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য তিন দিন আগে থেকে বলা হচ্ছে। মঙ্গলবার আবারও ওই সব এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি খারাপ হলে তাঁদের সরিয়ে আনা হবে।
ঘুমধুম ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঘুমধুম বেতবুনিয়া বাজার সংলগ্ন ছৈয়দ নুরের বসতঘরে একটি মর্টার শেল এসে পড়ে। এতে ঘরটির জানালা ভেঙে গেছে ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘুমধুম সীমান্তের নজরুল ইসলামের বাড়ি, রহমতবিল-সংলগ্ন আবদুল মান্নানের বাড়িসহ পাঁচটি বাড়িতে গুলির আঘাত লেগেছে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি মর্টারশেল এসে পড়ে ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়া ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বাড়ির উঠানে। এতে স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ নুর সিকদারের বাড়ির জানালার কিছু অংশ ফেটে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালা। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামে ছেলে মনিরুল ইসলাম জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বসতবাড়িতে একটি মর্টারশেল বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় বসতবাড়ির জানালা ও গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচন্ড শব্দে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে এতে কেউ আহত হননি।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত হয়ে মর্টারশেলের অংশ নমুনা হিসেবে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন।
এর আগে সোমবার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হন এক বাংলাদেশিসহ দু’জন। এর পর থেকে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এলাকার লোকজন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন।
উখিয়ার পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সোমবার রাত থেকে দুইপক্ষের লড়াইয়ের ভয়াবহতা বেড়ে গেছে। এত কম্পন আমরা আর দেখিনি। একেকটি গোলা নিক্ষেপের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। একটি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছেন লোকজন।’ তিনি জানান, ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, জলপাইতলী, মণ্ডলপাড়া, নয়াপাড়া, কোনারপাড়া, পশ্চিম কুল, বেতবুনিয়া বাজারপাড়া, পাশের পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আঞ্জুমানপাড়া, বালুখালী ও দক্ষিণ বালুখালী এলাকা প্রকম্পিত হচ্ছে। কোনোভাবেই বিস্ফোরণ বন্ধ হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে আসছেন অনেকেই। তাঁদের স্থানীয় লোকজন আটক করে বিজিবির কাছে সোপর্দ করছেন। এ পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন অনেকে।
ঘুমধুম ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাইশ পারি তঞ্চঙ্গ্যাপাড়া থেকে ২০টি পরিবার, ভাজাবনিয়া তঞ্চঙ্গ্যাপাড়া থেকে ৩০টি পরিবার, তুমব্র“ কোনারপাড়া থেকে ৩০টি পরিবার, ঘুমধুম পূর্ব পাড়া থেকে ২০টি পরিবার, তুমব্র“ হিন্দুপাড়া থেকে ১০টি পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।’
ঘুমধুম ইউপির চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, টানা কয়েক দিন ধরে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির কারণে আতঙ্কে আছেন এলাকাবাসী।
এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্য ছাড়াও পালিয়ে আসছেন দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্য, কাস্টমস কর্মী ও আহত সাধারণ নাগরিকেরা।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ শরিফুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ তথ্যমতে, ২৬৪ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে পালংখালী সীমান্ত দিয়ে এসেছেন ১১৪ জন। এখানে শুধু বিজিপি সদস্য নন, সেনাবাহিনীর সদস্য, কাস্টমস সদস্য ও আহত মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিক আছেন। এ মুহূর্তে কতজন আহত আছেন, তা জানাতে পারেননি তিনি।