দেশের তথ্য ডেস্ক:-
চলতি বছর মশার উপদ্রব বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, ২০২৩ সালকে বলা হয় দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ও সবচেয়ে বেশি মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের বছর। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন লাখ ২০ হাজার ৭০১ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন এক হাজার ৬৯৮ জন। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। এক বছরের ব্যবধানে ডেঙ্গু এতটা বৃদ্ধির কারণ সবার জানা থাকলেও দায় স্বীকার করছে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন যদিও দাবি করছে তারা প্রতিনিয়ত মশা নিয়ন্ত্রণের অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু সঠিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালনা না করে শুধু জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে তাদের কার্যক্রম। মশার লার্ভা ধ্বংসের ভুল পদ্ধতির কারণে এখনো তেমন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি নগর প্রশাসন। মশার লার্ভা নিধনের জৈব কীটনাশক বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) আমদানিতে প্রতারণার শিকার হয় ডিএনসিসি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্শাল এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানি থেকে ওষুধ এনেছে দাবি করলেও তা ওই কোম্পানি থেকে আনা হয়নি বলে জানা গেছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এসব নকল ওষুধই ব্যবহার করা হয়েছে মশক নিধনে।
তাছাড়া মশা মারতে ধোঁয়া দেয়া ফগিং পদ্ধতিও ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। মেলাথিওন নামের ওষুধ ৫৭ ইসি মাত্রায় আমদানির পর পাঁচ শতাংশ হারে জ্বালানি তেল ডিজেলের সঙ্গে মেশায়। ফগার যন্ত্রে এটি ধোঁয়া হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। অথচ চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহর পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকায় মশা নিধনের পদ্ধতিটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। তাতে মশা ধ্বংসের বদলে হয়েছে অর্থের অপচয়। ফগিংয়ে (পরিপক্ব মশা নিধনে ধোঁয়া ছিটানো) অর্থ অপচয় না করে লার্ভিসাইডিংয়ে (লার্ভা নিধনে ওষুধ ছিটানো) মনোযোগী হতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
মশক নিধনে দুই সিটির বড় অঙ্কের বাজেট থাকলেও নেই কীটতত্ত্ববিদ। দুই সিটিতে কীটতত্ত্ববিদের জন্য দুটি পদ থাকলেও দীর্ঘদিন বন্ধ নিয়োগ কার্যক্রম। ফলে কীটতত্ত্ববিদ ছাড়াই চলছে মশক নিধন বা মশার লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রম। ডেঙ্গু মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে স্থায়ী সমাধান খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণাধীন ভবনে বা শহরের কোনো স্থানে লার্ভা জন্মালে তার সঠিক সমাধান করার জন্য কীটতত্ত্ববিদ প্রয়োজন। কীটতত্ত্ববিদদের তদারকিতেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ডেঙ্গু যখন চারদিকে ভয়ানক আকার ধারণ করছে, তখনই রাজধানীতে বাড়ছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব, যা নগরবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিন্তু এ মশা নিধনে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির তেমন কোনো ভূমিকা চোখে পড়ছে না বলে নাগরিকদের অভিযোগ। ফলে বছরজুড়ে এডিস ও কিউলেক্স মশার বিস্তার ঘটেই চলেছে। হাসপাতালগুলোয় বাড়ছে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অধিকাংশ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। অনেক হাসপাতালে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।
ডিএসসিসি সূত্রমতে, মশা মারতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মশা নিধনে ব্যবহূত কীটনাশক কেনা হয়। বাকি আট কোটি ২৫ লাখ টাকা যন্ত্রপাতি কেনা ও পরিবহন খাতে ব্যয় করা হয়। গত অর্থবছরে এ খাতে খরচ করেছে প্রায় ৩১ কোটি টাকা।
ডিএনসিসি সূত্রমতে, মশা নিধনে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ডিএনসিসিও। এর মধ্যে মশা নিধনকাজ পরিচালনার জন্য ৮৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। মশার ওষুধ কেনার পেছনেই ব্যয় করে ৪৫ কোটি টাকা। আর ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করে বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োজিত মশককর্মীদের দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায়।
নাগরবাসীর অভিযোগ, মশা মারতে প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাজেট বাড়াচ্ছে দুই সিটি। কিন্তু কোনোক্রমেই মশাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বর্ষা মৌসুমে ছাড়াও এডিস মশা মারতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। মশা নিধনের নামে প্রতিবছর শতকোটি টাকা জলে ফেলছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের কাউকে কখনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। অথচ নগরে মশা নিধনের জন্য প্রতি মাসে গৃহ করের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতে হচ্ছে নাগরিকদের। সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, মশক নিধনে ডিএনসিসি কতটুকু সফল হয়েছে, তা জনগণই বলবে। বছরের প্রথমেই আমরা সব কার্যপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করি। তবে আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। সাধারণ মানুুষের বিভিন্ন অভিযোগ কখনো সম্পূর্ণরূপে এড়ানো সম্ভব নয়। যখনই কারো অভিযোগ পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছি। শুধু তা-ই নয়, আমরা রুটিনের বাইরেও কার্যক্রম চলমান রাখছি। মশক নিধনের ক্ষেত্রে যেন কোনো ঘাটতি না থাকে, সেদিকে আমাদের লক্ষ থাকে। কীটতত্ত্ববিদ নিয়ে অনেকের অভিযোগ থাকলেও আমাদের কীটতত্ত্ববিদ রয়েছে। তাছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিশেষজ্ঞের পরামর্শেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মাঝে একটি অভিযোগ উঠেছিল মশক নিধনের মেডিসিন নিয়ে। আমরা সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি সেটা নকল ছিল না।
ডিএসসিসি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের কার্যক্রমে মানুষ অবশ্যই উপকৃত হয়েছে। বর্তমানে কিউলেক্স মশার উপদ্রব চলছে। ডেঙ্গুর মৌসুম প্রায় শেষের দিকে; কিন্তু কিউলেক্স মশা বাড়ছে। আমরা বলতে পারি ডিএসসিসির মধ্যে মশক নিধন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যান্য বছরে কিউলেক্স মশার যে উপদ্রব ছিল, এবার তার ১০ ভাগের এক ভাগও নেই। আমরা সম্পূর্ণভাবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের লোকবল, যন্ত্রপাতি, মেশিন ও কীটসহ সবকিছুই রয়েছে। আমাদের যে বাজেট আছে, সে অনুযায়ী কাজ করেছি। বাজেটের প্রত্যেকটি টাকা সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ডিএসসিসিতে ডেঙ্গু বেশি নিয়ন্ত্রণে ছিল। শুধু তা-ই নয়, বাজেটের যে ব্যয়, তা আমরা ভবিষ্যতেও খরচ করার চেষ্টা করব। ডিএসসিসি আরও ভালো করার চেষ্টা করছে, যাতে মশা নিয়ে মানুষকে কষ্ট করতে না হয়। আমরা আগের তুলনায় মশক নিধনে অনেকটাই এগিয়ে গেছি।
চলতি বছরে দুই সিটি কর্পোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার আমার সংবাদকে বলেন, মশক নিধনের ক্ষেত্রে কতটুকু কাজ করতে পেরেছে, তা সাধারণ জনগণ ভালো বলতে পারবে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন যে উদ্দেশ্যে মশক নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, তা সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। তাই বলা যায়, তারা মশক নিধনে সফল হতে পারেনি। ২০২৩ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে মশাবাহিত রোগের জন্য সবচেয়ে খারাপ বছর গেছে। তিন লাখ ২০ হাজার ডেঙ্গু রোগী অতিক্রম করা এর আগে কখনো হয়নি। মশাকে দুইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রথমত, কিউলেক্স মশা ও দ্বিতীয়টি হলো এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ। দুটির নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই সেভাবেই কাজ করতে হবে। বিশেষ করে সারা বছর বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রতিটি বাসাকে চিহ্নিত করে মশক নিধনের কাজ চলমান রাখতে হবে। অন্যথায় আগামী বছরও ডেঙ্গু আমাদের ভোগাবে। দুই সিটি কর্পোরেশনে কীটতত্ত্ববিদের ঘাটতি আছে। তাই একাধিক লোক নিয়োগ দিয়ে এ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও কীটতত্ত্ববিদ থাকা জরুরি। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চার কম্পোনেন্টের বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ বছরব্যাপী করা জরুরি।