দেশের তথ্য ডেস্ক:-
আজ ৯ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক কপিলমুনি হানাদার মুক্ত দিবস। রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের টানা ৪ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আজকের দিনে রাজাকারদের আত্মসমর্পণ ও গণদাবির প্রেক্ষিতে সহচরী বিদ্যা মন্দিরের মাঠে ১৫৫ জন মতান্তরে ১৫১ জন যুদ্ধাপরাধী (রাজাকারদের) গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে পতন ঘটে দক্ষিণ খুলনার অন্যতম প্রধান এ রাজাকার ঘাঁটির।
যুদ্ধকালীন সময়ে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় মিলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী, খুলনার চুকনগরে অল্প সময়ে অধিক মানুষকে হত্যা করার ঘটনা ঘটে। এরপর খুলনার কপিলমুনিতেও ঘটে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের ঘটনা। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দন্ড কার্যকর করার ঐতিহাসিক ঘটনাটিও ঘটে কপিলমুনিতেই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সম্ভবত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের তাৎক্ষণিক সাজা দেওয়ার ঘটনা এটাই একক উদাহরণ।
৭১-এ কপিলমুনির রাজাকার রাজ্য :
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কপিলমুনির রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটিকে দখল করে রাজাকাররা সেখানে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। খুলনাঞ্চলের মধ্যে এই রাজাকার ঘাঁটিটি ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী। কয়েক শ’ রাজাকার এখানে অবস্থান নিয়ে আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দূর্ভেদ্য এই ঘাঁটিটি দখলে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেন, তবে এর অবস্থানগত সুবিধা, রাজাকারদের কাছে থাকা অস্ত্র সম্ভারের প্রাচুর্য এবং রাজাকারদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি এবং এলাকাবাসীর অসহযোগিতায় প্রথম দিকের অভিযানগুলো সফল হয়নি। প্রতিবারের যুদ্ধেই রাজাকাররা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে তারা আশপাশের মানুষদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিত, যাতে করে মুক্তিযোদ্ধারা এই অঞ্চলে কোনো গেরিলা সুবিধা পেতে না পারে। তাছাড়া এ অঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস হওয়ায় রাজাকারদের অত্যাচার-নির্যাতনও সীমাহীন পর্যায়ে পৌছায়। প্রথমে হিন্দু ধর্মাবলম্বী, কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থকদের ওপর তারা অবর্ণনীয় নির্যাতন করে। কপিলমুনিকে ঘাঁটি করে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলত এই নির্মম নির্যাতন। বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে লুটপাট, ধর্ষণ, অপহরণ ছিল রাজাকারদের নিত্যকর্ম।
একে একে দখল করা হয়েছিল প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারগুলোর সব সম্পদ। তবে প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারগুলোর কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য তাদের অনেককে বাঁচিয়ে রাখা হলেও অস্ত্রের মুখে অধিকাংশদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। মনি সিংহ, জ্ঞান সিংহ, নরেন সিংহ, কানু পোদ্দার, তারাপদ ডাক্তার, জিতেন্দ্রনাথ সিংহ, শান্তিরাম সিংহসহ আরো অনেককে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। ঐসময় তাদের সকলকে নিয়মিত নামাজ আদায়ে মসজিদে যেতে হতো বলে জনপদে এখনও প্রচার রয়েছে।
ঘাঁটিতে নিয়মিত ২ শ’রও বেশি রাজাকাররা সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে এমন কোন অপকর্ম নেই যে তারা করেনি। তারা ঐসময় বেদ মন্দির থেকে রায় সাহেবের শ্বেতপাথরের মূর্তিটি ভেঙে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়।
কপিলমুনি অঞ্চলে রাজাকারদের তান্ডবের খবর প্রচার হলে মুক্তিযোদ্ধারা এই রাজাকার ঘাঁটিটি দখল নিতে ডিসেম্বরের আগে অন্তত দু’বার আক্রমণ করে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১১ জুলাই আক্রমণে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট আরেফিন। এই যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন লতিফ, সরদার ফারুক আহমেদ, মনোরঞ্জন, রহমত আলী, মাহাতাপ, দীদার, আবদুর রহিম, আনোয়ারুজ্জামান বাবলু ও জাহান আলী। তাঁরা তালা উপজেলার জালালপুর থেকে গভীর রাতে রওনা দিয়ে শেষ রাতে কপিলমুনি এসে পৌছান।
মুক্তিযোদ্ধারা বাজারের দক্ষিণ দিক থেকে রাজাকার ঘাঁটিতে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। কপিলমুনিতে পৌছাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আক্রমণ শুরুর কিছু পরেই ভোর হয়ে যায়। দিনের আলোয় অল্প মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এত বড় ঘাঁটি দখল সম্ভব হবে না বিবেচনা করে মুক্তিযোদ্ধারা তালার জালালপুরে ফিরে যান।
এদিকে সুযোগ বুঝে রাজাকাররা শক্তি বৃদ্ধি করে জালালপুরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং বেশ কিছু অস্ত্র হাতছাড়া হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তখন ঘাঁটি ছেড়ে আরো পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তালা উপজেলায় নকশালপন্থীদের বেশ তৎপরতা ছিল। তারাও একবার কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করেছিল বলে একাধিক সূত্র জানায়। তবে নানা সমস্যা ও সংকটে তারাও সফল হতে পারেননি।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা আরো সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা ও সময় নিয়ে পরিপূর্ণ যুদ্ধের ছক নিয়ে রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণে পরিকল্পনা করে। মুজিব বাহিনীর এলাকা প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু ছিলেন যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রাথমিক পর্বে। তবে যুদ্ধ যেদিন শুরু হয় সেদিন তিনি কপিলমুনিতে ছিলেননা। কমান্ডারের জরুরি তলব পেয়ে তিনি তখন যুদ্ধের প্রয়োজনে ভারতে ছিলেন। তবে যুদ্ধের শেষ রাতে আবার ফিরে আসেন।
যুদ্ধের পরিকল্পনা :
বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই রাজাকার ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য তালা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের প্রধান ইউনুস আলী ইনুর নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে ঘাঁটিটি দখল নিতে শপথ করেছিলেন সহযোদ্ধারাও। পরিকল্পনা মোতাবেক রাজাকার ক্যাম্পটি সহযোদ্ধাদের নিয়ে রেকি করেন ইউনুস আলী ইনু। এর একদিন পর তালা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে। আক্রমণকারীরা মুক্তিযোদ্ধা ইনুকে না পাওয়ায় তথ্যানুযায়ী সেদিন মাগুরা গ্রামের ৩৫ জনকে হত্যা করে।
এতে মুক্তিযোদ্ধারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে অতি দ্রুত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করেন। এতে ইউনুস আলী ইনু, স ম বাবর আলী, গাজী রহমতউল্লাহ, লেফটেন্যান্ট সামসুল আরেফিন, আবদুস সালাম মোড়ল, সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, গাজী রফিকুল ইসলাম, শেখ আবদুল কাইয়ুম অন্যান্যরা অংশ নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর রাত ৩টায় রাজাকার ক্যাম্পের তিনদিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ করা হবে। মাদ্রা গ্রাম থেকে কপিলমুনির উত্তর ও পূর্ব অংশে আক্রমণ করার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইনুর ওপর। দক্ষিণ এবং পশ্চিম অংশে আক্রমণ করার দায়িত্ব পড়ে স.ম বাবর আলী, রহমতউল্লাহ দাদু এবং লেফটেন্যান্ট আরেফিনের ওপর।
পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা স.ম বাবর আলী ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বাধীন ৫০ জনের মুক্তিসেনার দলটি নাসিরপুর ব্রিজ পার হয়ে কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন। রহমতউল্লাহ ও ওমর ফারুক তাঁদের বিস্ফোরক দল নিয়ে রাজাকার শিবিরের দু’ পাশে পৌছায়। আবু ওবায়দুরের দলটি আরসিএল নিয়ে কানাইদিয়ার পাড় থেকে ক্যাম্পে আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়। ইঞ্জিনিয়ার মুজিবরের নেতৃত্বে একদল অবস্থান নেন আরসনগর। সেখানকার কালভার্ট উড়িয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁদের। নৌ-কমান্ডো বজলুর রহমান ও হুমায়ুনের নেতৃত্বে একটি দল রাজাকার ক্যাম্পের পাঁচিল ও মূল ঘাঁটিতে বিস্ফোরক লাগানোর দায়িত্বে ছিল। মোড়ল আবদুস সালামের নেতৃত্বে রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিল্লুর রহমানসহ ২০ জনের একটি দল রাজাকার ঘাঁটির ২৫-৩০ গজ দূরে অবস্থান নেয়; যাতে তাঁরা রাজাকার ঘাঁটির বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারেন। আজিজুল হকের নেতৃত্বে ১০ জনের আরো একটি দল ছিল একটু দূরের পাইকগাছার শিববাটি নদীর মোহনায়। ভাসমান মাইন নিয়ে তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন। যাতে নৌপথে রাজাকারদের সহায়তায় কোনো গানবোট আসার চেষ্টা করলে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায়।
শুরু হয় আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ:
পরিকল্পনামতো ৪ ডিসেম্বর রাতে সবাই তাঁদের নির্দিষ্ট পজিশনে চলে যান, শুরু হয় আক্রমণ। রাজাকাররাও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। রাত শেষ হয়ে ভোর হয়, একটি নতুন দিনের সূচনা। কিন্তু যুদ্ধ থেমে থাকে না। দু’ পক্ষেই বেশ গোলাগুলি চলতে থাকে। দিনের আলো বাড়তে থাকে, সূর্যের আলোর তেজের সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণও বাড়তে থাকে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়; একসময় দুপুরও পার হয়ে যায় কিন্তু যুদ্ধ থামে না। রাজাকাররা তিন দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়লেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দেওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে থাকে। কৌশলগতভাবে তারা ভালো অবস্থানে এবং মুক্তিযোদ্ধারা খোলা স্থানে থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের আক্রমণ অব্যাহত রাখেন।
এই যুদ্ধে প্রথমদিকে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। তাদের মনে ভীতি ছিল, রাজাকার ঘাঁটির পতন না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে তাদের ওপর রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু যুদ্ধের কৌশল ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার লক্ষণ দেখে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ, রাজাকারদের তথ্য, ঘাঁটির বর্ণনা প্রদান, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সহযোগিতা করে। মুক্তিসেনা ও এলাকাবাসীর সম্মিলিত প্রয়াসের এই জনযুদ্ধে রাজাকাররা সম্পূর্ণভাবেই একটি ব্যূহের মধ্যে আটকে যায়। রাজাকাররা বাইরে থেকে খাবার বা অন্যান্য কোনো সহযোগিতা পায়নি।
চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সমানে আক্রমণ করে চললেও রাজাকাররা প্রথমত দমে যায়নি বরং মাইক্রোফোনে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বিশ্রী নোংরা ভাষায় গালাগালি করছিল এবং আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারাও তখন মাইকে পাল্টা তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার জন্য বলতে থাকেন। যুদ্ধের একদিন পর যখন এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন তখন কমান্ডাররা যুদ্ধের কৌশল খানিকটা বদল করেন। কেউ কেউ বিশ্রামে আর কেউ কেউ আক্রমণে যেতে শুরু করেন। রাতের বেলায় গুলি করতে করতে এগোচ্ছিলেন গাজী আনসার। হঠাৎ করে একটি গুলি তাঁর বুক ভেদ করে চলে যায়, তিনি শহীদ হন। তবে ওই রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আরসিএলের সাহায্যে রাজাকার ক্যাম্পের ছাদের বাঙ্কার উড়িয়ে দেন। পাঁচিলের অংশবিশেষও ধ্বংস হয়। এতে রাজাকাররা আর ছাদে উঠে গুলি করতে পারছিল না।
এই যুদ্ধে রহমতউল্লাহ দাদু সব সময়ই ছিলেন সক্রিয়। তিনি কখনো পরিকল্পনায় ব্যস্ত, কখনো দরাজ গলায় কাউকে নির্দেশ দিয়ে চলেছেন। কখনোবা নিজেই আক্রমণে গেছেন। কালাম ছিলেন বালিকা বিদ্যালয়ে। এ-সময় আচমকা তোরাব আলী অন্যপথে এগোতে গেলে তিনি আহত হন। গুলি তাঁর পেটের এক পাশে লেগে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাঁকে চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হয়। রুহুল আমিন গুলি করতে করতে এগোচ্ছিলেন। এ-সময় রাজাকারদের গুলিতে তিনি আহত হন। রাজাকারের গুলিতে ইটের দেয়াল ভেঙ্গে তাঁর শরীরে লাগে এবং একটি গুলি তাঁর কুচকিতে লাগে। এর পরের দিন আহত হন মুক্তিযোদ্ধা খালেক। তাঁর দুই পা ভেঙে যায়। খালেকের আর্তচিৎকার শুনে আব্দুস সালাম এগিয়ে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্যে পাঠিয়ে দেন। খালেক আহত হওয়ায় আনোয়ারের জেদ চেপে যায়। তিনি বেপরোয়াভাবে রাজাকারদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। এমন সময় একটি গুলি আনোয়ারের মুখে লেগে পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারও মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।
সহযোদ্ধা আনোয়ারের মৃত্যুতে মুক্তিযোদ্ধাদের রোখ যেন আরো চেপে যায়। বাকি সবাই প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। সাহিদুর রহমান কুটুর ওপর আনোয়ারের লাশ দাফনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথমে তাঁকে তালার শাহাজাদপুরে কবর দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর পুনরায় তাঁকে তাঁর বাড়ি বেলফুলিয়ায় কবর দেওয়া হয়। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-গোলাবারুদের সংকট দেখা দেয়।
ইতোমধ্যে মুক্তাঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ থেকে সুবোল চন্দ্র মল লঞ্চযোগে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসেন। নতুন করে পাওয়া অস্ত্র-গোলা-বারুদ এবং এলাকাবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধারা এবারে আরো বীরবিক্রমে রাজাকারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে রাজাকাররা প্রস্তাব দেন যে, ‘আমরা বাবর আলীর সাথে আত্মসমর্পণের কৌশল নিয়ে কথা বলতে চাই।’ কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা কেউই তাদের এই প্রস্তাবে আস্থা রাখতে পারেনি। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ওমর ফারুককে বাবর আলী পরিচয়ে রাজাকারদের সঙ্গে কথা বলতে পাঠানো হয়। রাজাকাররা তাদের নিশ্চিত পশ্চাৎপসারণের সুযোগ দাবি করায় আলোচনা ভেঙ্গে যায়। শুরু হয় আবারও তুমুল লড়াই।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে যৌথ কমান্ড গঠিত হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ শুরু করেছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর উড়ে যাওয়া দেখা যাচ্ছিল কপিলমুনির আকাশ থেকেও। এতে করে রাজাকারদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। রাজাকার শিবির দখল যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন রাজাকাররা যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে। এক সময় রাজাকাররা সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পন করলে ৯ ডিসেম্বর তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে গ্রেপ্তার করার পর দেখা যায়, রাজাকারদের অনেকেই রাতের আঁধার ও যুদ্ধের ফাঁকে সরে পড়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনুর মতে, ধৃত রাজাকারদের সংখ্যা ছিল ১৭৭। তবে তাঁরা শীর্ষস্থানীয় দুইজন রাজাকারকে ধরতে পারেননি। এরা হচ্ছে ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার খুলনা জেলার প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমান এবং রাজাকার কমান্ডার শেখ আনসার আলী। এই আনসার আলী পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
রাজাকার ঘাঁটি দখলের পর মর্মান্তিক দৃশ্য:
রাজাকারদের ঘাঁটি দখল করার পর সেখানে দেখা যায় একের পর এক লোমহর্ষক দৃশ্য। একটি কক্ষে দেখা যায়, যীশুর মতোই ঘরের দেয়ালে পেরেক ঠুকে রাখা হয়েছে তালা উপজেলার মাছিয়ারা গ্রামের রহিম বক্স গাজীর ছেলে সৈয়দ গাজীকে। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়ে তিনি ক্যাম্পের খবর বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার করতেন। রাজাকাররা তাঁর প্রকৃত পরিচয় জেনে যাওয়ায় গোটা শরীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সেই কাটা জায়গায় লবণ পুরে দেয় এবং যীশু খ্রিস্টের মতো হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে দেয়ালে আটকে রাখে।
ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্রে দেখা যায়, ওই রাজাকার ক্যাম্পের মাধ্যমে এক হাজার ছয়শত এক জনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে হত্যা করতে কপিলমুনি ও এর আশপাশের এলাকার আরো এক হাজার জনের নামের একটি তালিকা পাওয়া যায় ঘাঁটিতে। রাজাকারদের গ্রেপ্তার ও ঘাঁটি দখলের খবর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের গ্রামের মানুষরা এসে ভিঁড় করে কপিলমুনিতে।
মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল কাইয়ুম সে দিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেন, ‘চারদিক থেকে এলাকাবাসী পিঁপড়ের সারির মতো এসে স্কুল মাঠে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দিরের মাঠে জড়ো হয়। তাঁরা তাঁদের হাতে রাজাকারদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দাবি জানাতে থাকেন। সকলেই এক একজন রাজাকারকে দেখিয়ে বলতে থাকেন, এ আমার ভাইকে মেরেছে, ও আমার বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে।’ মুক্তিযোদ্ধা কাইয়ুম স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে বলেন, ‘আমার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু বলে, এরা আমার বাবা মনির চেয়ারম্যানকেও হত্যা করেছে।’ হত্যাকারীদের সামনে দেখে তখন নিজেরাও খুবই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন।’’
কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া রাজাকারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে যুদ্ধের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু ঘোষণা করেন, গ্রেপ্তার হওয়া রাজাকারদের বন্দি অবস্থায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তাঁর এই ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এলাকাবাসী।
জনতার আদালতে রাজাকারদের বিচার:
আত্নসমর্পণকৃত রাজাকারদের অন্য কোথাও নিয়ে যেতে দিতে রাজি হননি। অবশেষে জনতার চাপের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বিচার কপিলমুনিতেই করার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক করা হয়, আদালত বসিয়ে রাজাকারদের বিচার করা হবে, প্রত্যেক রাজাকারের বিরুদ্ধে আলাদা ভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ চাওয়া হবে এবং প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেই শুধু সেই রাজাকারকে দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হবে।
আট মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। তাঁরা হলেন, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ইউনুস আলী ইনু, স ম বাবর আলী, গাজী রহমতউল্লাহ, স ম আলাউদ্দিন, মোড়ল আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদ ও শেখ আব্দুল কাইয়ুম। জনগণ প্রত্যেক রাজাকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন। একজন রাজাকার বাদে সেখানকার বাকি রাজাকারদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ প্রভৃতির মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই অভিযোগের পক্ষে জনতা সাক্ষ্য-প্রমাণও হাজির করেন।
সকাল ৯টার দিকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা অবধি এই বিচার কাজ চলে। এখানে অপরাধীদের পক্ষে সওয়াল এবং যুদ্ধাপরাধী এসব দুর্বৃত্তদের মুক্তিযোদ্ধারা বা সাধারণ নাগরিকরা বিচার করতে পারে না এই যুক্তি তুলে ধরে একটি দীর্ঘ বক্তব্য উপস্থাপন করেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ কামরুজ্জামান টুকু। এসময় সেখানে জড়ো হওয়া ২০ থেকে ৩০ হাজারের মতো মানুষ সে-সময়ে যে যেভাবে পেরেছিল ওই রাজাকারদের ওপর হামলে পড়ে অনেকেরই মৃত্যু নিশ্চিত করে।’
মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল কাইয়ুমের মতে, মানুষের সকল রোষ ওই রাজাকারদের সাজা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা যায়, সেদিন রাজাকারদের ১৫৭ জন আত্নসমর্পন করলেও ২ জনকে বয়স বিবেচনায় ছেড়ে দিয়ে বাকি ১৫৫ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে তাদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মতান্তরে এর সংখ্যা ছিল ১৫১ জন।
এছাড়া জনগণের রায়ে ‘সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারদের মধ্যে সাধারণ জনতা বেছে বেছে ১১ রাজাকারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। এই ১১ রাজাকার অতিনির্মম অত্যাচারী ছিল। জনতা এদেরকে গুলি করে হত্যা করার পরিবর্তে কষ্ট দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার দাবি তোলে এবং এক পর্যায়ে নিজেরাই এদের ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনিতে মৃত্যুদন্ড দেয়। যেভাবে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে গোটা শরীর চিরে তাতে লবণ পুরে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল, ঠিক তেমনি এসব রাজাকারকেও সারা শরীর ব্লেড দিয়ে কেটে তাতে লবণ পুরে মাঠে ফেলে রাখা হয়।’
রাজাকারদের শেষ পরিণতি:
এই শীর্ষস্থানীয় ১১ রাজাকারের মধ্যে আট জনের নাম বলতে পেরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সালাম। এরা হচ্ছে মাওলানা আফছার, সৈয়দ ফকির, আফতাব কারী, আবদুল মালেক, মতি মিয়া, শেখ হাবিবুর রহমান, আমিনউদ্দিন মুন্সী এবং মশিউর রহমান। বাকি ৩ জন ছিলেন, দাইদ গাজী, ওয়াদুদ কারিকর ও নূরুল ইসলাম বলে জানান, কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সভাপতি সরদার ফারুখ আহমেদ। এদের সবারই বাড়ি ছিল কপিলমুনি এবং সংলগ্ন এলাকায়। এরা এতোই নৃশংস ছিল যে অত্যাচার করে হত্যা নিশ্চিত করেও মানুষের ঘৃণা, ক্ষোভের রেশ কাটেনি। মানুষ ওইসব মৃত-অর্ধমৃত শরীরের ওপরেও লাথি-কিল-চড় মেরে তাঁদের ক্ষোভের বহি:প্রকাশ করেছিলেন।
মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় রাজাকারদের মৃতদেহগুলো স্কুল মাঠে প্রথমত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো থাকে। লাশগুলোর দায়িত্ব আব্দুস সালাম মোড়লের ওপর দিয়ে শেখ কামরুজ্জামান টুকু অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে খুলনা অভিমুখে রওনা দেন। এতগুলো লাশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সালাম এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তিনি এলাকায় মাইক দিয়ে ঘোষণা করেন, লাশগুলো তাদের স্বজনরা এসে নিয়ে যেতে পারে। রাতের বেলা লাশগুলো রক্ষার জন্য পাহারারও ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কেউই লাশ নিতে আসেনি। একদিন পর ২/৩ টি লাশ স্বজনরা নিয়ে যায়। রাতের বেলা লাশ পাহারায় থাকায় হয়তো কেউ ভয়ে লাশ নিতে আসছে না ভেবে পরের দিন রাতের পাহারা তুলে নেওয়া হয়। তারপরও বেশি লাশ পরিষ্কার হয়নি।
এদিকে কয়েকদিন গত যাওয়ায় লাশগুলোতে পচন ধরা শুরু হয়। রাজাকারের লাশ কবর দেওয়ার ব্যাপারে এলাকাবাসীর কোনো আগ্রহ না থাকায় শেষ পর্যন্ত তিন-চারদিন পরে ওই লাশগুলো পাশের কপোতাক্ষ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। মতান্তরে কিছু লাশ মাঠের পাশেই একসাথে কবর দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের নির্ধারিত জায়গা বে-দখল:
সর্বশেষ গত ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রলায়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর এর টেন্ডার ও ওয়ার্ক অর্ডার হলেও নির্ধারিত জায়গা নিজেদের বলে দাবি করে তা দখলে নিয়ে সেখানে পাকা ইমারত নির্মাণ কাজ করেছে মহল বিশেষ।
এ ব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল-আমীনের ব্যবহৃত মোবাইলে বারংবার ফোন দিয়েও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এর আগে সাবেক ইউএনও মমতাজ বেগম বলেছিলেন, নির্ধারিত স্থানেই মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ হবে। তবে কিছু অংশ ব্যক্তি মালিকানায় চলে যাওয়ায় তা অধিগ্রহনসহ সব সমস্যার সমাধান করে যথাস্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ হবে।
কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সভাপতি সরদার ফারুখ আহমেদ বলেন, তাদের সংগঠনের উদ্যোগে আজ ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। এরমধ্যে সকাল ১০ স্থানীয় অমৃতময়ী মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এর আগে প্রত্যুষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বদ্ধভূমিতে পুষ্পমাল্য অর্পনের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচী শুরু করা হবে বলেও জানান তিনি।