ভারতে যাতায়াতে নানা ধরনের জটিলতা ও বিড়ম্বনার কারণে অনেক বাংলাদেশি পাসপোর্ট যাত্রী আগ্রহ হারাচ্ছে ভারত ভ্রমণে।

banapol-1.jpg

মিলন হোসেন বেনাপোল থেকে,
ভারতীয় ভিসা প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, ভ্রমণ কর বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ-ভারত দুই চেকপোস্টে নানা হয়রানির কারণে কমে গেছে ভারতগামী যাত্রীর সংখ্যা। ভারতে যাতায়াতে নানা ধরনের জটিলতা ও বিড়ম্বনার কারণে অনেক বাংলাদেশি পাসপোর্ট যাত্রী আগ্রহ হারাচ্ছে ভারত ভ্রমণে। এ ছাড়া ভারতগামী পাসপোর্ট যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার, শারীরিক নির্যাতন এবং টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল ভঙ্গ করে যাত্রীদের আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চেকপোস্টে কর্মরত এপিবিএন এর বিরুদ্ধে। ফলে দুই দেশের পাসপোর্ট যাত্রীসহ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসা, ব্যবসা, শিক্ষা ও ভ্রমণের জন্য বেশির ভাগ বাংলাদেশি যাত্রী ভারতে যায় বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ৭৯৮ জন যাত্রী ভারতে যাতায়াত করেছে। ভিসা প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি ও ভ্রমণ কর বৃদ্ধির পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে চার লাখ ২৬ হাজার ৬৩৯ জন যাত্রী ভারতে যাতায়াত করেছে। একই সময়ে যাত্রীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪২ হাজার ১৫৯।

বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা সুবিধা দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ভারত-বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তি বিদ্যমান। সেই চুক্তি অনুযায়ী ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বাংলাদেশিদের পাঁচ বছর মেয়াদি ভিসা পাওয়ার কথা। আর ৬৫ বছরের কম বয়সী ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়া হতো এক বছর মেয়াদি। সেই সাথে ব্যবসায়ীদের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের ভিসা প্রদান করা হতো।
আগে ভিসার আবেদন করলে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্য ভিসা পাওয়া গেলেও এখন তা দুই থেকে তিন মাসেও সম্ভব হচ্ছে না। আর ভিসা দিলেও তার মেয়াদ তিন থেকে ছয় মাস। যাত্রীদের ভ্রমণ কর চলতি বাজেটে বাংলাদেশ সরকার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করায় যাত্রীদের বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। সে জন্য ইমিগ্রেশনে যাত্রীর সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে। সাধারণ যাত্রীদেরও ব্যাগেজ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

অন্ধ, খোঁড়া, প্রতিবন্ধী কাউকে ছাড় দিচ্ছে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এমনকি খাদ্যতালিকার চকলেট, শনপাপড়ি, বিস্কুট, এক কেজি জিরা, চিনি পর্যন্ত আটক করে মেমো দিয়ে দিচ্ছে যাত্রীদের হাতে। ভারতীয় কাস্টমসও যাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি করে থাকে। এ ছাড়া ভারত চেকপোস্টে বিএসএফ ও বেনাপোল চেকপোস্টে বিজিবির দুই দফা তল্লাশির কারণে যাত্রী কমে গেছে অনেকাংশে। ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে এ খাতে।
একাধিক ভুক্তভোগী যাত্রী জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় যাত্রীরা ভোররাতে চেকপোস্ট সংলগ্ন আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে।
এ সময় স্থানীয় কিছু দালালের সহযোগিতায় তিনি জনপ্রতি ২০০ টাকা নেন। এরপর দায়িত্বে থাকা এপিবিএন সদস্যরা বিকল্প পথে তাদের টার্মিনাল ভবনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। এভাবে তারা মাসে আয় করছেন লাখ লাখ টাকা।
পাসপোর্ট যাত্রী এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, সিরিয়াল ভেঙে টাকার বিনিময়ে যাত্রীদের আগে পারাপারের সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে প্রায়ই যাত্রীদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে তাদের নানা রকম হুমকি দেন এপিবিএন পুলিশের সদস্যরা । এমনকি মহিলা পাসপোর্ট যাত্রীকে লাইন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এমন ভিডিও ভাইরালও হয়েছে।
ঢাকা থেকে আসা যাত্রী হোসাইন বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতকারী যাত্রীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আগে যেভাবে লাগেজ সুবিধা পেতাম এখন তা পাচ্ছি না। বর্তমানে যেভাবে ব্যাগ তল্লাশি করছে তাতে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’
শহিদুল ইসলাম নামের এক যাত্রী বলেন, ‘ভ্রমণ কর ৫০০ টাকা ও ল্যান্ডপোর্ট চার্জ ৫৩ টাকা দিয়ে ভারতে ভ্রমণ করেছি। এখন ভ্রমণ কর এক হাজার টাকা করায় আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে আমাদের অনারেবল ভিসা দেওয়া উচিত এবং ভ্রমণ করটা উঠিয়ে দেওয়াও উচিত বলে আমি মনে করি। ৫০০ টাকার ভ্রমণ কর এক লাফে এক হাজার টাকা করায় তা আমার মতো অনেক ট্যুরিস্টের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে।’
ইলিয়াস হোসেন নামের একজন যাত্রী বলেন, ‘আমরা যারা ভারতের ভ্রমণের জন্য ভিসা নিতে যাচ্ছি তাদের পাসপোর্ট জমা দেওয়ার এক থেকে দুই মাস পর সিরিয়াল পাচ্ছি। আর ভিসা পেতে লাগছে দেড় থেকে দুই মাস। সব মিলিয়ে ভিসা পেতে তিন থেকে চার মাস সময় লেগে যাচ্ছে। এতটা সময় যদি ভিসা পেতে হয় তাহলে মানুষ কিভাবে যাওয়া-আসা করবে? এ কারণে এখন বর্ডারে লোকও কমে যাচ্ছে।’
উত্তমকুমার নামের একজন যাত্রী বলেন, ‘আগে যে পরিমাণ যাত্রী যাতায়াত করত এখন তেমন নেই। আগে যেভাবে লাগেজ সুবিধা পেতাম বর্তমানে তা পাচ্ছি না। বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এসব সমস্যার কোনো সমাধান না হলে আগামীতে আরো যাত্রী কমে আসবে।’
সোলাইমান নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমার পিতা ক্যান্সার রোগী। ভারতে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে বাসার জন্য কয়েকটি মালামাল এনেছিলাম। চেকপোস্ট কাস্টমস অফিসাররা তা সিজ করে একটি মেমো হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা এক হাজার টাকা সরকারের ভ্রমণ কর দিয়ে ভারত যায় । সাধারণ যাত্রীরা ব্যাগেজ রুলের যে সুবিধা পাওয়ার কথা সেটা কাস্টমস দিচ্ছে না।

এ বিষয়ে বেনাপোল সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. মহসিন আলী বলেন, যে পরিমাণ যাত্রী বেনাপোল দিয়ে যাতায়াত করে, ভ্রমণ কর বৃদ্ধির পর আগস্টের প্রথম থেকে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। ফলে সরকারের ভ্রমণ করের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়।
বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোঃ রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন আগে ছয় থেকে থেকে সাত হাজার যাত্রী ভারতে যাতায়াত করত। সম্প্রতি যাত্রী সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আশা করছি খুব শিগগিরই যাত্রী যাতায়াত স্বাভাবিক হবে।’

Share this post

PinIt
scroll to top