দেশের তথ্য ডেস্ক:-
বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, আইনজীবী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সহকর্মীকেও পিটিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে সমালোচনা হলেও শাস্তি হয়নি তাঁর। ফলে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। সর্বশেষ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে থানায় নিয়ে বেদম মারধরের ঘটনায় অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন-অর-রশীদ সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন।
গতকাল সোমবার তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়েছে, এডিসি হারুন-অর-রশীদকে ‘জনস্বার্থে সরকারি কর্ম হতে বিরত রাখা আবশ্যক ও সমীচীন, তাই তাঁকে আজ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ৩১তম বিসিএসের এই পুলিশ কর্মকর্তা একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। বিশেষ করে ডিএমপির রমনা জোনের এডিসি হওয়ার পর থেকেই অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
গণমাধ্যমে এই নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি আমলে নেননি। যদিও হারুন বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অথবা নিজের কাজের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
সর্বশেষ গত শনিবার রাতে থানা পুলিশ নিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদকে নির্মম মারধর করেন তিনি। এ ঘটনা তদন্তে পুলিশের তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটিকে আগামী দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিক্ষোভ করেছে ছাত্রলীগসহ কয়েকটি ছাত্রসংগঠন।
আগে থেকেই বেপরোয়া এডিসি হারুন
ডিএমপি রমনা জোনের আওতায় রয়েছে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, হাইকোর্ট, জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এসব জায়গায় বিভিন্ন সময় মিছিল, মানববন্ধন হয়।
সেসব কর্মসূচিতে এডিসি হারুন যাওয়া মানেই একটি পেটানোর ঘটনার জন্ম। গত বছরের সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে একটি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের পিটিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি।
এর আগে নিজ সহকর্মীকেও চড় মেরে সমালোচিত হয়েছিলেন এডিসি হারুন। নিউ মার্কেট এলাকায় দোকান মালিক, বিক্রেতা ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের দিকে রাবার বুলেট ছুড়তে এক কনস্টেবলকে নির্দেশ দেন তিনি। বুলেট শেষ বলায় তাঁকে চড় মারেন তিনি। ঘটনাটির একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষের দিন হারুন দানবের মতো আচরণ করছিলেন।
গত বছরের ৪ মার্চ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ঢাকা ক্লাবের সামনে একটি মিছিলে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ও সাদা পোশাকের লোক হঠাৎ লাঠিপেটা করে। একই বছরের ২৮ ফেরুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে রাজনৈতিক সমাবেশে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে বিচার চেয়ে শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও অন্যান্য বাম সংগঠন আয়োজিত মশাল মিছিলে লাঠিপেটা করে পুলিশ। সেখানেও হারুন মারমুখী ভূমিকায় ছিলেন। গত বছরের মাঝামাঝি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলনে পুলিশের লাঠিপেটার ছবি তুলতে গিয়ে হারুনের অসদাচরণের শিকার হন কয়েকজন সাংবাদিক।
এর আগে সুপ্রিম কোর্টে দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের পিটিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন এডিসি হারুন। আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের লাঠিপেটা এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালও করেন তিনি। ওই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন ডিএমপির কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
কে এই এডিসি হারুন
হারুনের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের থানাঘাটা গ্রামে। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, এলাকায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাঁর নিকটাত্মীয়রা। মুক্তিযুদ্ধের সময় হারুনের নানা বাবর আলী সানা রাজাকার ছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন।
গতকাল সরেজমিনে হারুনের বাড়ির এলাকায় গেলে বিভিন্ন সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, হারুনের পিতা জামালউদ্দীন গাজী কর্মজীবনে পাশের গ্রাম মাড়িয়ালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। মাড়িয়ালা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছিলেন হারুন। তাঁর মা শেফালী বেগম একজন গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় হারুন।
ছোট ভাই শরীফুল ইসলাম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুজ্জামান সোহাগের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপসম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত। শরীফুল ইসলাম ছাড়া তাঁদের নিকটাত্মীয়দের কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানা গেছে। তবে শরীফুলের বিরুদ্ধে অন্যের জমি দখল করে ঘের করার অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানাঘাটা গ্রামের এক ব্যক্তি জানান, হারুনের চাচাতো ভাইদের বেশির ভাগ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। চাচা গোলাম বারী ও হযরত আলী ভুট্টো একাধিক নাশকতা মামলায় জেলও খেটেছেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে হারুনের বাবা জামালউদ্দীন গাজীর মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
হারুনের মামা হুমায়ুন কবির বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী। এ বিষয়ে শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রভাষক দীপঙ্কর বাছাড় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাবর আলী সানা চিহ্নিত ও স্বীকৃত রাজাকার ছিলেন। আর ভাই শরীফুল ছাড়া হারুনের পুরো পরিবার ও মাতুল (মায়ের দিকের আত্মীয়) গোষ্ঠীর সবাই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।’
হারুন ২০০৫-০৬ সেশনে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় শুরুর দিকে হারুন ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। এরপর হল শাখা ছাত্রলীগের এক নেতার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। পরে আরো অনেক ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেই সুবিধা নিয়ে হলে কোনো পদ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কমিটি গঠনের পর বর্ধিত কমিটিতে সহসম্পাদক পদ পান। তবে ছাত্রলীগের আরেকটি সূত্রের দাবি, তিনি সহসম্পাদক নন, পরিবেশবিষয়ক উপসম্পাদকের পদ পেয়েছিলেন। তবে ছাত্রলীগের কোনো দায়িত্বশীল সূত্র থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সহযোগিতা করেন শীর্ষ ছাত্রলীগ নেতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই তাঁকে সহযোগিতা করতেন এক শীর্ষ ছাত্রলীগ নেতা। তিনি পুলিশের এএসপি হয়ে গেলে তাঁদের মধ্যে সখ্য বাড়ে। তত দিনে ওই ছাত্রলীগ নেতাও কেন্দ্রের বড় নেতা হয়ে যান। এরপর থেকে ছাত্রলীগ নেতার বন্ধু হিসেবে বিভিন্ন মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ডিএমপির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত রমনা জোনের এডিসি হিসেবে পদায়ন হয় তাঁর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হল ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি বি এম মারুফ বিল্লাহ বলেন, ‘হারুনের বাড়ি আর আমার বাড়ি একই এলাকায়। আমি সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সভাপতি ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদক ছিলাম। কেন্দ্রের উপসম্পাদক ছিলাম। আমি কখনোই হারুনকে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগ করতে দেখিনি।’
পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে আস্থা রাখছে ছাত্রলীগ
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পুলিশ যে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে তার ওপর আস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। গতকাল সোমবার ডিএমপি সদর দপ্তরে কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘যারা দায়ী তাদের যেন যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। সে জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছি।’
ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ নেতার পরিবার মামলা করতে চাইলেও ছাত্রলীগ করতে দিচ্ছে না—এমন অভিযোগের বিষয়ে সাদ্দাম বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। সুষ্ঠু বিচার বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শাস্তি যেন নিশ্চিত করা হয়, সেটি নিয়ে আমরা কথা বলেছি।