র‌্যাগিংয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু!

jadavpur-12082023-01.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক:- 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার বগুলা থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে পড়তে এসেছিলেন স্বপ্নদীপ কুণ্ডু। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। কিন্তু তার স্বপ্নপূরণ হলো না। গত বুধবার গভীর রাতে ছাত্র হোস্টেল চত্বরে স্বপ্নদীপকে নগ্ন ও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া যায়। বৃহস্পতিবার ভোরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় অনার্সের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থীর।

ছাত্রের মৃত্যুতে হইচই পড়ে গেছে। প্রথমেই অভিযোগ ওঠে, হোস্টেলে বসবাসকারী সাবেক ছাত্রদের র‌্যাগিংয়ের মুখে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন স্বপ্নদীপ। হোস্টেলের তিনতলা থেকে তিনি ঝাঁপ দেন। এক শিক্ষার্থী তাকে রোখার চেষ্টা করলেও তিনি সফল হননি। স্বপ্নদীপকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করার সময় তার শরীরে পোশাক ছিল না। শরীরে আঘাত ছিল বেশ কয়েকটি জায়গায়। এতে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ জোরালো হয়েছে।

র‌্যাগিংয়ের যে বয়ান বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে, তা চমকে দেওয়ার মতো। সোমবার বাড়ি থেকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন স্বপ্নদীপ। বুধবার প্রথম ক্লাসে যান। কিন্তু রাতের অভিজ্ঞতা তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। সে কথা মাকে টেলিফোনে জানান ওই শিক্ষার্থী।

অভিযোগ, তাকে সমকামী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে আবাসিকদের একটা অংশ। তিনি সমকামী নন, এমনটা প্রমাণ করতে চান। এ কথা চিৎকার করেও নাকি বলেছিলেন স্বপ্নদীপ। সেই রাতেই নগ্ন অবস্থায় তাকে পড়ে থাকতে দেখা যায় হোস্টেল চত্বরে।

খুনের অভিযোগ
মৃত শিক্ষার্থীর বাবা ওই হোস্টেলের কয়েকজন আবাসিকের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ করেছেন। সেই অনুযায়ী মামলা করেছে পুলিশ। ১০-১২ জন আবাসিককে ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যদিও যাদের তলব করা হয়েছে, তারা সকলে তদন্তকারীদের সামনে আসেননি।

ছাত্র-ছাত্রী থেকে অধ্যাপক এবং তাদের সংগঠন এই ঘটনায় নিন্দায় মুখর। সামাজিক মাধ্যমেও প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় যান আচার্য তথা রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।

শুক্রবার তিনি রাজভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী পরিবারকে আশ্বাস দিয়েছেন, অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তি হবে। যাদবপুর কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

কর্তৃপক্ষের ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ নতুন নয়। নতুন আসা শিক্ষার্থীদের ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। মুখ বুজে তা সহ্য করতে হয়, নইলে জোটে হেনস্থা। ডিন অফ স্টুডেন্টসকে নালিশ করেও সুরাহা হয় না বলে অভিযোগ।

ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আলাদা হোস্টেলে রাখার কথা। বৃহস্পতিবার তাদের জন্য সেই ছাত্রাবাস বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু সেটা স্বপ্নদীপের জীবনের বিনিময়ে!

যাদবপুরের শিক্ষার্থী মুস্তাক আহমেদ মোল্লা বলেন, হোস্টেল সুপার ও কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় দিনের পর দিন এসব ঘটনা ঘটছে। তা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আমরা নিয়মিত এ নিয়ে আন্দোলন করি। যারা নজরদারিতে গাফিলতি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার অভিযোগ
কর্তৃপক্ষের কঠোর মনোভাবের অভাব এ ধরনের মৃত্যুকে ডেকে আনছে, এমনটাই মত শিক্ষার্থী ও অধ্যাপকদের একটা বড় অংশের। অনেকেই একে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার তকমা দিচ্ছেন।

র‌্যাগিংয়ে দোষী প্রমাণিত হলে বহিষ্কার শুধু নয়, অপরাধীর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগও থাকে না। এমন কড়া আইন থাকা সত্ত্বেও কেন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারছেন না?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, যারা হোস্টেলে দাপট দেখায়, তাদের নেপথ্যে রাজনৈতিক মদত থাকে। ইউজিসির ২৪ ঘন্টার হেল্পলাইন আছে, যেখানে অভিযোগ জানানো যায়। কিন্তু সেই অভিযোগ ঘুরে আসবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছেই। রাজ্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কঠোর প্রশাসক নেই, যিনি রাজনৈতিক প্রভাব অতিক্রম করে পদক্ষেপ নেবেন।

নেপথ্যে ছাত্র রাজনীতি?
ফের সেই রাজনীতির কথাই উঠে আসছে। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, প্রশাসনিক মদত ছাড়া এসএফআই, টিএমসিপির মতো ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে র‌্যাগিংয়ের মতো জঘন্য অপরাধ চালিয়ে যেতে পারে না।

এর পাল্টা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এখন সরাসরি আচার্যের নিয়ন্ত্রণে। এটা রাজ্যপালের ব্যর্থতা।

এই তরজার বাইরে আসল ছবিটা কী? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যাদবপুরের এক শিক্ষার্থী বলেন, পড়াশোনার পর্ব শেষ হলেও অনেকে গেস্ট হিসেবে হোস্টেলে বছরের পর বছর থেকে যায়। এখানে থেকেই চাকরিবাকরি করে। এতে থাকা-খাওয়ার খরচ কম হয়। এর সঙ্গে রয়েছে বহিরাগতরা। এরাই দাপট দেখায় হোস্টেলে, ভোটে জেতার জন্য ইউনিয়ন এদের উপরই ভরসা করে।

এই দাবি সত্য বলে জানান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। তিনি বলেন, আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হিসেবে হোস্টেলে ছিলাম, তখন পরিবেশ অন্যরকম ছিল। শিক্ষকরা হোস্টেলে আসতেন, নজর রাখতেন। এখন কোথায় সেসব!

তার মতে, কর্তৃত্ববাদী ছাত্র রাজনীতির পরম্পরা চলছে। ছাত্র সংগঠনগুলি তাদের স্বার্থে হোস্টেলে একশ্রেণীর আবাসিকদের দাদাগিরিতে মদত দেয়। অতীতে আবাস চত্বরে মদ্যপান, গাঁজা সেবনের বিরুদ্ধে যখন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছেন, তখন ছাত্র আন্দোলনের নামে তার বিরোধিতা করা হয়েছে। এ সবের পরিণতিতে ছাত্রের প্রাণ চলে গেল।

Share this post

PinIt
scroll to top