কয়রা প্রতিনিধিঃ অরবিন্দ কুমার মণ্ডল
“পর্যটন শান্তির সোপান” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সারাদেশে উদযাপিত হয়েছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। কিন্তু অনুমোদনের তিন বছর পার হয়ে গেলেও শুরু হয়নি কয়রার পর্যটনের নির্মাণকাজ।
সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে অবস্থিত খুলনার কয়রা উপজেলা। এই উপজেলার মোট আয়তন ১হাজার ৭৭৫ দশমিক ৪১ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ১হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটারই সুন্দরবনের অংশ।
কয়রায় আছে মসজিদকুঁড় মসজিদ, রাজা প্রতাপাদিত্যের বাড়ী, খালে খাঁর ৩৮ বিঘা দীঘি, আমাদী বুড়ো খাঁ-ফতে খাঁর দীঘি, বেদকাশীর দীঘি ও শীল পুকুরসহ নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থাপনা।
এ উপজেলায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের গোলখালীতে একটি পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় ট্যুরিজম বোর্ড। একই অর্থবছরে খুলনা জেলা প্রশাসক বরাবর দুই কিস্তিতে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দও ছাড় করে কর্তৃপক্ষ। সেখানে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করতে চাইলে বন বিভাগের আপত্তিতে সম্ভব হয়নি। এরপর ট্যুরিজম বোর্ডের অনুমতিতে স্থান পরিবর্তন করা হয়। কয়রা সদর ইউনিয়নের সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকা কেওড়াকাটায় পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর পার হয়ে গেছে তিন বছর। নির্মাণকাজ আর শুরু হয়নি।
কয়রা উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে শাকবাড়ীয়া নদীর তীরের ৬নং কয়রা গ্রামের অবস্থান। আজ শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, নদীর এক পাশে লোকালয়, অন্য পাশে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন। লোকালয়ের পাড়ে নদীর বেড়ীবাঁধ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে সবুজ ঘন বন। গোলপাতা থেকে শুরু করে ম্যানগ্রোভ বনের প্রায় সব প্রজাতির গাছ রয়েছে বনে। প্রথম দেখাতেই মনে হবে এটি সুন্দরবনেরই অংশ।
লোকালয়ের পাড় থেকে দেখা যায়, জঙ্গলের ধারে ঘাস খাচ্ছে চিত্রল হরিণ। গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বানর। সুন্দরী, গরান, কেওড়া, গেওয়া, পশুর, আমরুল, গোলসহ নাম না-জানা অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষের সমারোহ। নদীতে দেখা যায় কুমির ও শুশুক। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, লোকালয়ের পাড়ের গ্রামটির নাম ৬ নং কয়রা। নদীর ওপারে সুন্দরবনের মধ্যে একটি খাল রয়েছে, যার নাম কেওড়াকাটা। সেই খালের নাম অনুসারে গ্রামের নদীতীরবর্তী জায়গাটিতেই কেওড়াকাটায় পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের কথা।
৬নং কয়রা গ্রামের বাসিন্দা গনেশ চন্দ্র মুণ্ডা বলেন, ‘গত তিন বছর আগে যখন জানতে পেরেছিলাম এলাকার নদীর চরের বাগানে কেওড়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ হতে যাচ্ছে, তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। প্রশাসনের লোকজন এসে যায়গা দেখে লাল ফ্লাগও টানিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।’
কয়রা সদর ইউনিয়নের সুন্দরবনসংলগ্ন কেওড়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের স্থানের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য সরদার নাজমুস ছায়াদাত বলেন, ‘এখানে বাইরে থেকে অনেক মানুষ আসেন। তাঁরা নদীর পাশে বসে অথবা নৌকায় চড়ে সুন্দরবনের দৃশ্য উপভোগ করে সময় কাটিয়ে আবার চলে যান। পর্যটনকেন্দ্রটি স্থাপন হলে পর্যটকেরা আরও বেশি সময় ধরে উপভোগ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে এলাকার মানুষের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্রও তৈরী হবে। কিন্তু নির্মাণকাজে কালক্ষেপণ কেন হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।
কেওড়াকাটায় একটি পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবী জানিয়ে আসছিলেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইনেসিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্টের (আইসিডি) কর্মীরা। সংগঠনের পরিচালক আশিকুজ্জামান বলেন, ২০১৫ সাল থেকে সুন্দরবনের পাশে ৬ নং কয়রা গ্রামসংলগ্ন এলাকাটিকে ‘কেওড়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র’ নাম দেন স্থানীয় তরুণেরা। তখন থেকেই ঐ এলাকায় একটি পর্যটনকেন্দ্রের দাবী জানিয়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করেন তাঁরা। অবশেষে সেখানেই পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হওয়ায় অনেক খুশি হয়েছেন সংগঠনের কর্মীরা। কিন্তু সবকিছুই ঠিক থাকলেও গত তিন বছরেও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।
কয়রা শাকবাড়ীয়া স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ এসে এমন আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে অবস্থিত কয়রায় নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থাপনা আছে। পর্যটনকে ঘিরে এ উপজেলায় অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এখান থেকে বঙ্গোপসাগরও খুব কাছে। দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কয়রাসহ এর আশপাশে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটবে। তা ছাড়া সুন্দরবনের পাশের ঐ এলাকায় রয়েছে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের বাস। যা পর্যটকদের খুব সহজেই আকর্ষণ করবে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস বলেন, ‘বন বিভাগের আপত্তির কারণে পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের জন্য যায়গা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতায় কিছুটা কালক্ষেপন হয়েছে। তবে বর্তমানে যেখানে পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেখানে বন বিভাগের আপত্তি নেই। ইতিমধ্যে নতুন করে কাজের নকশা তৈরি করেছি। আশা করছি কেওড়াকাটায় পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরু হবে।