দেশের তথ্য ডেস্ক :- আজ বিশ্ব বাঘ দিবস। ২০১০ সালে বাঘ অধ্যুষিত ১৩টি দেশ রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে এ রাজসিক প্রাণীটিকে রক্ষার জন্য সম্মেলন করে। বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিলসহ নানা প্রকৃতিবাদী সংগঠনের আহ্বানে ১৩টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরা সম্মিলিতভাবে বাঘ রক্ষার অঙ্গীকার করেন। ওই সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
সেন্ট পিটার্সবার্গ সম্মেলনে স্থির হয়, ২০২২ সালের চীনা বাঘ বছরের মধ্যে বিশ্বের বনবাসী বাঘের সংখ্যা শুধু স্থিত করা নয়, দ্বিগুণ করা হবে। বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিল এই বাঘ অধ্যুষিত দেশগুলোর আগে থেকেই কাজ করছিল। দেখভালের দায়টা তাদের দেওয়া হলো। আর ২৯ জুলাই তারিখটি বাঘদের সম্মানে বরাদ্দ করা হলো।
প্রকল্পের হাঁকডাক ভালোই চলছিল। ২০১৬ সালের গণনায় দেখা গেল, এক শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো বাঘ বেড়েছে। বাঘ বিশেষজ্ঞরা খুঁজে বের করলেন গণনার খুঁত। অনেক দেশই, এমনকি সবচেয়ে বেশি বন্য বাঘের অধিকারী ভারতের বেশ কিছু জঙ্গলের বাঘ গোনা হয়েছিল পায়ের ছাপ গোনা পদ্ধতিতে।
অন্য দেশগুলোতেও এটাই হয়ে আসছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাঘ গণনা করা হয় ক্যামেরা ট্র্যাপ বসিয়ে তোলা ছবি থেকে ডোরা দাগ সমীক্ষার মাধ্যমে।
এর মধ্যে নেপাল আর ভারতের কয়েকটি টাইগার রিজার্ভ ছাড়া আর কোথাও বাঘ তো বাড়েইনি, বরং আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে বন্দি বাঘ আছে এই ১৩টি দেশের বন্য বাঘেরও দ্বিগুণ। চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধশিল্পের কাঁচামাল সরবরাহের জন্য অনেক পোষা বাঘ ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু চীনা ওষুধ প্রস্তুতকারীরা তাতে খুশি নয়। তাদের চাই টাটকা বুনো বাঘের মাংস, হাড় ও মজ্জা। ফলে কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের জঙ্গলগুলো বাঘশূন্য হয়ে গেছে। এই সব ওষুধ প্রস্তুতকারীর প্রতিনিধিরা স্থানীয় আদিবাসী শিকারিদের হাতে ডলার গুঁজে দিয়ে বুনো বাঘের দফারফা করে দিয়েছে।
স্বীকার করতেই হবে, আগের সরকারগুলোর চেয়ে আমাদের বর্তমান সরকার বাঘ সম্পর্কে অনেক সচেতন। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বন বিভাগের যতটা এগিয়ে আসা উচিত, তারা তাতে সাড়া দিতে সক্ষম হয়নি।
বাস্তবতার দিক থেকে দেখলে, সুন্দরবন ছাড়া আমাদের আর কোনো বাঘের জঙ্গল নেই। এই জঙ্গল একসময় ছিল শুধু বন বিভাগের শাসনাধীন। শুধু খুনখারাবির তদন্তে পুলিশ বনে ঢুকত। কিন্তু এখন বনের তত্ত্বাবধায়ক বন বিভাগ পুলিশের সঙ্গে আছে বিজিবি, কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ, টাইগার রেসপন্স টিম ও পোর্ট অথরিটি। এদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সামান্য।
একসময় সুন্দরবনের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ডাকাতরা। প্রায় ১৪টি দলের ডাকাতের বহর এত ক্ষমতাবান ছিল যে বন বিভাগ বাধ্য হয়ে তাদের প্রায় ৩০টি টহল ফাঁড়ি তুলে দিয়েছিল। পাটকোষ্টা, ভ্রমরখালী, পাশাখালী, ঝালিয়া বন অফিসগুলো ডাকাতরা ব্যবহার করত। এই ডাকাতরা মাছ ও মধু ডাকাতি করত, বনজীবীদের অপহরণ করত। গাছচোরদের, হরিণ শিকারিদের নিরাপত্তা দিত। নিজেরা খাওয়ার জন্য নিয়মিত হরিণ মারত; বাঘ, কুমিরও সামনে পড়লে ছাড়া পেত না।
র্যাব ও সাংবাদিক মহসিন উল হাকিমের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় সুন্দরবন এখন প্রায় জলদস্যুর রাহুমুক্ত। বন বিভাগের উচিত ছিল ডাকাতমুক্ত ঘোষণার পরপরই সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণভার শক্তভাবে নিয়ে নেওয়া। সেটা তারা করতে পারেনি।
কিছুকাল আগে সরকার বন বিভাগের বেতন বাড়িয়েছে। মাঠ পর্যায়ে বন বিভাগের দায়িত্বকাল পুলিশের মতো দিনের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা। একসময় তারা সেনাবাহিনীর মতো শৃঙ্খলা মেনে চলত। কিন্তু বাড়ানো বেতন এখন মুদ্রাস্ফীতির বন্যায় ভেসে গেছে। ফলে জঙ্গলে বনকর্মীদের যে দুরবস্থার মধ্যে থাকতে হয়, তাতে তাদের নৈতিকতার মান শুধু নিম্নগামীই হতে পারে।
গত কয়েক বছরে ডাকাতির চেয়ে ভয়াবহ সমস্যা বিষ সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে সুন্দরবনের খালে, ঝরায়। এই খুনিরা রিপকট, রোটেক্সের মতো ভয়াবহ কীটনাশক দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে সাদা মাছ চিংড়ি ধরে। শোনা যায়, বন বিভাগের অল্প কিছু কর্মী আধা বখরায় এই খুনে ব্যবসার অংশীদার। আবার বৈধ এলাকায় বিষ মারার জন্য দলপ্রতি পাঁচ হাজার আর অভয়ারণ্য এলাকায় জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা দিতে হয় বিষমারাদের। পাগরাতলী, হেঁতালবুনিয়া, মামদো নদীর খালগুলোয়, খেজবদানা, ইলশামারী, আঠারোবাকি, কুইঞ্চে এলাকায় এই সন্ত্রাসীদের অত্যাচার বেশি।
পূর্ব সুন্দরবনে চাত্রী, চাইলেবগী, চরপুটিয়ায় জঙ্গল কেটে তারা মাছ শুকায়। তিন মাসের বাদা বন্ধের সময় বিষ সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম বেড়ে যায়। এ বছর জঙ্গলে মহাল করা মৌলেদের কাছে জেনেছি, তারা জঙ্গলে অনেক জায়গায় হরিণ শিকারের ফাঁদ—ডোয়া দেখেছেন। হরিণ মারার পর আগেকার দিনে এই ডোয়া তুলে নেওয়া হতো। এখন জঙ্গলেই পাতা থাকে। কারণ সারা বছরই হরিণ মারা চলে।
বনের প্রশান্তি বিনষ্টকারী আরেক উৎপাত সৃষ্টি করেছে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক। কোনো ইকোলজিক্যাল বিচে ভ্রমণ করতে হলে ভ্রমণকারী ও আয়োজক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেশসংক্রান্ত শিক্ষার দরকার হয়। একদলে ১০ জনের বেশি পর্যটক প্রবেশাধিকার দেওয়া এ ধরনের পর্যটন আদর্শের বিরোধী। এক এলাকায় তিনটির বেশি বোট প্রবেশের অনুমতি দেওয়া গর্হিত। এর অন্যথা হচ্ছে। বিরাট বোটে শতাধিক উচ্চকিত যাত্রী নিয়ে সাত-আটটি বোট কটকায় দেখা নৈমিত্তিক ব্যাপার।
আমি একবার একটা ফিল্মের জন্য টোপ দিয়ে মাচায় বসে ছিলাম। বাঘিনীটি গরু খাচ্ছিল। হঠাৎ দেখতে পাই, বোটের সার্চলাইট এসে বাঘিনীর গা ছুঁয়ে গেল। বোটটি ঘন গাছপালার আড়ালে ছিল বলে যাত্রীরা বাঘ দেখতে পায়নি। কিন্তু বাঘ বিরক্ত হয়ে মড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে সুন্দরবন জড়িয়ে। সুন্দরবনের রক্ষাকর্তা হচ্ছে এর বাঘসম্পদ। সরকারকে উদ্যোগী হয়ে বন বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। বন বিভাগকে উন্নত অস্ত্র, নিরাপদ বাসস্থান, দ্রুত চলাচলক্ষম যানবাহন, কিছু পরিমাণে তাত্ক্ষণিক বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া দরকার। সমকালের বাজার বিবেচনায় বেতন কাঠামোর উন্নয়ন—ঝুঁকি, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি করে বন বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে অধিকতর কৈফিয়তের আওতায় আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান শুধু বন বিভাগের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। খবরদারি করবে না। পর্যটন সীমিত করতে হবে বনের সীমান্ত থেকে ১০ মাইলের মধ্যে। বড় বোট ঢোকা বন্ধ করে দিতে হবে। বাঘ বাঁচাতে হলে, বাড়াতে হলে বন প্রশাসনের খোলনলচে পাল্টে নতুন আদর্শে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। না হলে একসময় শুধু ছবি দেখে বাঘ দিবস পালন করতে হবে।