গাজী টায়ারে আগুন-লুটপাট : নিখোঁজ ১৭৬ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে

8789678-1.jpg

আগস্ট ২৭, ২০২৪

অবশেষে নিয়ন্ত্রণে এসেছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকায় অবস্থিত গাজী টায়ার ফ্যাক্টরির আগুন। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট ২১ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় গতকাল সোমবার রাত ৭টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন কারখানাটিতে রোববার রাত ১০টার দিকে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।

এর আগে কারখানাটিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এদিকে ছয়তলা ভবনের কারখানাটিতে ১৭৬ জন নিখোঁজ বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজনরা। তবে তাদের ভাগ্যে কী আছে জানে না কেউ। কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, নিখোঁজ ব্যক্তিরা কারখানার শ্রমিক নন, তারা বাইরের লোক। লুটপাট করতে গিয়ে তারা আটকা পড়ে থাকতে পারে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল মো. রেজাউল করিম বলেছেন, ফায়ার সার্ভিসের ১২ ইউনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। হতাহতের বিষয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না। পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন নিখোঁজের তালিকা করছেন। আমরা উদ্ধার কাজ এখনো শুরু করতে পারিনি। কারণ ভবনটিতে অস্বাভাবিক আগুনের তাপ রয়েছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলেই উদ্ধারকাজ শুরু করা হবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাঙ্ক কারখানা রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাঙ্ক কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। একপর্যায়ে ওই দুটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

রোববার রূপগঞ্জের নবকিশোলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোমান মিয়া হত্যা মামলার আসামি গোলাম দস্তগীর গাজীকে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের খবরে ওইদিন সন্ধ্যার দিকে শতশত লোক লাঠিসোটা নিয়ে গাজী টায়ার কারখানার ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারখানার ভেতরের ছয়তলা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে কয়েক শতাধিক লোক। ওই ভবনে কেমিক্যাল ও টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিল। ভবনের ভেতরে লুটপাট নিয়ে দুটি পক্ষের মাঝে হাতাহাতি ও মারধরের ঘটনাও ঘটে। এ সময় একটি পক্ষ ভবন ত্যাগ করলে ভবনের প্রবেশ গেট বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে পুরো ভবনে আগুন লেগে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা ৬০ থেকে ৮০ ফুট উঁচুতে ওঠে। ভবনের ভেতরে আটকা পড়া অনেকেই স্বজনদের ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানায় বলে বেশ কয়েকজন স্বজন দাবি করেছেন। খবর পেয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিস, ডেমড়া ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভাকে কাজ শুরু করে। পরে ২১ ঘণ্টা পর গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এদিকে, ভবনে প্রবেশ করে নিখোঁজ হয়েছেন এমন ব্যক্তির খুঁজে গাজী টায়ার কারখানায় ভিড় করেছেন স্বজনরা। অনেককে কান্না ও আহাজারি করতে দেখা গেছে। এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কাছে ১৭৬ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছেন স্বজনরা। বেশিরভাগ নিখোঁজদের বাড়ি উপজেলার মিকুলী, রূপসী কাজিপাড়া, ছাতিয়ান, মুগরাকুল, কাহিনা, বরপা, মাসাবো, তারাব, বরাব, মুড়াপাড়াসহ আশপাশের এলাকায়।

বরপা এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমার বন্ধু আলী আসাদ, আবু সাঈদ, স্বপন খান, শাহিনসহ পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছে। তারা কারখানার ওই ভবনে রাত (রোববার) সাড়ে ৯টার দিকে ঢুকে আর বের হয়নি। মোবাইল ফোনে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কথা হয়েছে। তখন বলেছে তারা ভবনে আটকা পড়েছে। আমাদের বাঁচাও। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি।’

কোনাপাড়া এলাকার রাবেয়া খাতুন বলেন, তার মেয়ের জামাই হযরত আলী গাজী টায়ার কারখানায় মালপত্র নিতে এসেছিল। বাড়ি থেকে বলে এসেছে। এখন আর তার খোঁজ পাচ্ছি না। শুনছি আগুন লাগছে যেই ভবনে সেখানে আটকা পড়েছে।

মাসাবো এলাকার আসাদ মিয়া বলেন, তার ছোট ভাই বাবু মিয়া কসাইয়ের কাজ করে। বন্ধুদের সঙ্গে গাজীর কারখানা থেকে মাল নিতে এসেছিল। রোববার রাত ১০টা পর্যন্ত কথা হয়েছে, এরপর থেকে আর খোঁজ নেই।

বরপা এলাকার সুরাইয়া বেগম বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার নাতি নিরব ও তার বন্ধু মিল্লাত কারখানায় প্রবেশ করে। পরে যেই ভবনে আগুন লেগেছে ওই ভবনে আটকা পড়ে। এখন আর খোঁজ পাচ্ছি না।

ভয়াবহ এই আগুনে কারখানার আশপাশের মার্কেট, হাটবাজার, শিল্প কলকারখানা এবং এলাকাবাসী চরম আতঙ্কে রয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিএনপি নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘গাজী সাহেব অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির জায়গা এই কারখানা। কারখানা ধ্বংস করলে এখানে কর্মরত ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কোথায় যাবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, কেউ কোনো ধরনের অরাজকতা, লুটপাট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে।’

আগুনের বিষয়ে গাজী টায়ার কারখানার অ্যাডমিন ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। সরকারের সহযোগিতা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটি ফের চালু করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, কারখানায় ঢুকে যারা আটকা পড়েছে, তারা কেউ শ্রমিক নন, বাইরে থেকে আসা লোকজন।

Share this post

PinIt
scroll to top