দেশের তথ্য ডেস্কঃ
চলতি বছর প্রথমার্ধে গত বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় রাজধানীর বায়ুদূষণ কিছুটা কমেছে। এর পরও ৯ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ ছিল রাজধানীতে। সব মিলিয়ে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসের গড় বায়ুমান সূচক বিবেচনায় রাজধানীর বাতাস ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’।
রাজধানীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণ থেকে রাজধানীর বায়ুদূষণের এই চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ ঢাকার ৯ বছরের বায়ুমান সূচক (একিউআই) বিশ্লেষণ করেছে ক্যাপস।
ক্যাপসের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে ঢাকার প্রথম ছয় মাসের গড় বায়ুমান সূচক ১৭৩। অন্যদিকে ২০২৪ সালে প্রথম ছয় মাসে ঢাকার গড় বায়ুমান সূচক ছিল ১৮৩, যা অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ আট বছরের গড় বায়ুমান বিবেচনায় এ বছর প্রথম ছয় মাসে ঢাকার বায়ুদূষণ ৭.৫৯ শতাংশ বেশি ছিল।
তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রথম ছয় মাসে ঢাকার বায়ুদূষণ কিছুটা কমেছে। গত বছর প্রথম ছয় মাসে ঢাকার গড় বায়ুমানসূচক ছিল ১৯৩। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রথম ছয় মাসে বায়ুদূষণ কমেছে ৫.৩১ শতাংশ।
এ বিষয়ে ক্যাপসের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গতবারের তুলনায় বায়ুদূষণ যতটুকু কমেছে, তা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু না।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ইটভাটা, নির্মাণকাজের সমন্বয়হীনতা—এগুলোর কোনোটিতেই উন্নতি করার মতো ব্যবস্থা নিতে পারিনি আমরা। বৃষ্টিপাত বা প্রাকৃতিক কোনো কারণে যদি বায়ুমানের উন্নতি ঘটে, সেটাকে ব্যবস্থাপনার উন্নতি হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তদারকি ও আইন প্রয়োগের অভাবেই এই বায়ুদূষণ কমানো যাচ্ছে না।’
বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী বায়ুমানসূচক ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে ভালো বা বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়।
সূচক ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। ১৫১ থেকে ২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বায়ুমানসূচক যত বেশি হয়, বায়ুদূষণ তত বেশি।
বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এক যৌথ প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো, ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং নির্মাণকাজ থেকে সৃষ্ট দূষণ। তবে ক্যাপস বায়ুদূষণের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো, নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, আন্তর্দেশীয় দূষণ (নেপাল ও ভারত থেকে আসা দূষিত বাতাস), রান্নাঘরের ধোঁয়া এবং শহুরে বর্জ্য।
৯ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ
২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসের বায়ুমান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছর (২০২৩) ঢাকায় বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি ছিল। এর পরের অবস্থানে অর্থাৎ দূষণের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাস। প্রতিবছরই প্রথম ছয় মাসের গড় বায়ুমান বিবেচনায় রাজধানীর বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। এ সময় রাজধানীতে সবচেয়ে কম বায়ুদূষণ ছিল ২০২০ সালে। কভিডের সময় এ বছর ঢাকার গড় বায়ুমানসূচক ছিল ১৬০।
অস্বাস্থ্যকর প্রথম ছয় মাস
চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে ঢাকার গড় বায়ুমানসূচক ছিল ১৮৩, যা মূলত অস্বাস্থ্যকর বাতাসকে বোঝায়। এই ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছিল জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে। বছরের প্রথম দুই মাসে রাজধানীর বাতাস ছিল খুব অস্বাস্থ্যকর। পরের দুই মাস অর্থাৎ মার্চ ও এপ্রিলে বাতাসের মান কিছুটা ভালো হয়। এ সময় ঢাকার বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। মে ও জুনে বাতাসের অবস্থার আরো কিছুটা উন্নতি হয়।
ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত মাস ছিল জানুয়ারি। এই মাসে ঢাকার গড় বায়ুমানসূচক ছিল ২৪৮, যা খুব অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে নির্দেশ করে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দূষণ ছিল গত (জুন) মাসে। এ মাসে ঢাকার গড় বায়ুমানসূচক ছিল ১১৭, যা সতর্কতামূলক অবস্থাকে বোঝায়।
গত দুই মাসে এক দিন নির্মল বাতাস পেয়েছে রাজধানীবাসী
ক্যাপসের গত দুই মাসের (মে ও জুন) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত দুই (মে ও জুন) মাসের মোট ৬১ দিনের মধ্যে ১৭ দিন অস্বাস্থ্যকর, ৩৩ দিন সতর্কতামূলক, ১০ দিন মধ্যম বা গ্রহণযোগ্য এবং এক দিন নির্মল বাতাস পাওয়া গেছে রাজধানীতে। ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এর ফলে হওয়া ঝড়-বৃষ্টিতে গত ২৭ মে রাজধানীর বায়ুমানসূচক ছিল ৪৯, যা নির্মল বা বিশুদ্ধ বাতাসকে নির্দেশ করে।
জুলাইয়ের প্রথম পাঁচ দিন সহনীয় মাত্রার বাতাস
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসের প্রথম পাঁচ দিন সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য মাত্রার বাতাস পাওয়া গেছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২১.৯ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ৪.৪ গুণ বেশি। মূলত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনার পরিচালক মো. জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় আমরা ‘জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ নামে একটি পরিকল্পনা তৈরি করছি, যেখানে দূষণ চিহ্নিতকরণ ও কমানোর উপায় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে পিএম ২.৫ রাজধানীতে প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম এবং সারা দেশে ১৫ মাইক্রোগ্রাম কমানো সম্ভব। এখন বাস্তবায়নটাই মূল বিষয়। বায়ুদূষণ কমাতে সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অংশগ্রহণ ও সমন্বয় জরুরি।’
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শ্বাসনালীর অসুস্থতা ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগ দূষিত বায়ুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ সিওপিডি চারটি প্রধান অসংক্রামক রোগের একটা যেটাতে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক বহু লোক ভোগে। বায়ুতে থাকে বিভিন্ন দূষক ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। আমাদের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হবে। যতদিন না আমাদের বায়দূষণ নিয়ন্ত্রণে আসছে, ততদিন সবারই বাইরে বের হলে মাস্ক পরা উচিত।’