দেশের তথ্য ডেস্কঃ
মহেন্দ্র সিং ধোনি মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে নুয়ান কুলাসেকেরার বলে ছয় হাঁকাচ্ছেন, এটাই গত ১৩ বছর ধরে ভারতের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ছিল। একটা বিশ্বকাপের জন্য এরপর থেকে হন্যে হয়ে ঘুরেছে টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু আসেনি। সাতমাস আগেই নিজেদের মাটিতে হেরেছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল।
সেই আক্ষেপ মিটল নিজ থেকে বহুদূরের মাটিতে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপ বার্বাডোজের কড়া রোদের নিচে আরেকবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত। ১৭ বছর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরের শিরোপা ঘরে তুলেছিল ম্যান ইন ব্লুরা। সেটা দিয়েই শিরোপার পথে নেমেছিল ধোনির ভারত। লম্বা অপেক্ষা শেষে আবারও সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়েই শিরোপাখরা ঘুচালো দলটা।
ম্যাচ শেষে আবেগতাড়িত রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি কিংবা হার্দিক পান্ডিয়ার মুখটাই বলে দিচ্ছিল এই বিশ্বকাপের জন্য কতটা মরিয়া ছিল পুরো ভারত। বিরাট কোহলি ফাইনালের দিন চাপের মুখে খেললেন এবারের বিশ্বকাপে নিজের সেরা ইনিংস। ৫৮ বলে তার ৭৬ রানের ওই একটা ইনিংস ভিত গড়ে দিয়েছিল তাদের।
বার্বাডোজে উৎসবের মঞ্চ আগেই সাজিয়ে রেখেছিল ভারত। ১৭৬ রানের শক্ত সংগ্রহ তারা দাঁড় করায় ফাইনালের মঞ্চে। বল হাতে শুরুটাও ছিল চ্যাম্পিয়নদের মতোই। মাঝে কুইন্টন ডি কক আর হেনরিখ ক্লাসেন দাঁড়ালেন দেয়াল হয়ে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার জয়টাও ছিল সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার নামের পাশে যে লেগে আছে চোকার্স তকমা। ২৪ বলে ২৬ রানের সমীকরণটাই আর মেলানো হয়নি তাদের। আর্শদ্বীপ সিং আর জাসপ্রিত বুমরাহ একের পর এক ডট ডেলিভারিতে চাপ বাড়িয়েছেন। সঙ্গী ছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। স্নায়ুচাপের লড়াইয়ে জয় হলো ভারতেরই।
শেষ ওভারে দরকার ছিল ১৬ রান। হার্দিক পান্ডিয়ার ওই ওভারের প্রথম বলেই বাউন্ডারি লাইনে মিলারকে দুর্দান্ত এক ক্যাচে ফেরালেন সুর্যকুমার যাদব। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ শেষ হয়ে গেল সেখানেই। শেষ ওভারে এলো ৮ রান। ব্যর্থ হলো হেনরিখ ক্লাসেনের ২৭ বলে ৫৪ রানের দুর্দান্ত সেই ইনিংস। ৭ রানের জয়ে বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন ভারত।
এর আগে বার্বাডোসে ১৭৭ রান তাড়ায় আর্শদীপ সিংয়ের বলে চার মেরে ভালো শুরুর আভাস দিয়েছিলেন রিজা হেনড্রিক্স। তবে পরের ওভারে জসপ্রিত বুমরাহর বিপক্ষে টিকতে পারেননি তিনি। ডানহাতি এই পেসারের মিডল স্টাম্পে পড়ে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে বলের লাইন মিস করে বোল্ড হয়েছেন হেনড্রিক্স। বুমরাহর আউটসুইং যেন বুঝেই উঠতে পারেননি ডানহাতি এই ওপেনার। ফর্মহীনতায় পুরো বিশ্বকাপ কাটানো হেনড্রিক্স ফিরেছেন ৪ রানে।
পরের ওভারে আউট হয়েছেন এইডেন মার্করামও। আর্শদীপের অফ স্টাম্পের বাইরের স্লোয়ার ডেলিভারিতে কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে পান্তকে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি। প্রোটিয়া অধিনায়কের ব্যাট থেকেও এসেছে ৪ রান। টপ অর্ডারের দুজনকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে প্রোটিয়ারা। ১২ রানে ২ উইকেট হারানোর পর ডি ককের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ট্রিস্টিয়ান স্টাবস। এদিন শুরু থেকেই ঝড়ো ব্যাটিং করতে থাকেন তিনি। বিপদে পড়া সাউথ আফ্রিকাকে অনেকটা টেনে তুলেছেন ডানহাতি এই ব্যাটার।
যদিও নবম ওভারে স্টাবসের ঝড় থামিয়েছেন অক্ষর। বাঁহাতি এই স্পিনারের বলে অফ স্টাম্পের অনেকটা বাইরে গিয়ে ফাইন লেগ দিয়ে উড়িয়ে মারার চেষ্টা বলের লাইন মিস করেছেন স্টাবস। ফলে বোল্ড হয়ে ফিরতে ৩১ রান করা এই ব্যাটার। ধীরগতির ব্যাটিংয়ে সাউথ আফ্রিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ডি কক। উইকেটের খোঁজে আর্শদীপকে বোলিংয়ে এনেছিলেন রোহিত। আগের বলে ফাইন লেগ দিয়ে চার মেরেছিলেন ডি কক। পরের বলের জন্য সেখানে ফিল্ডার হিসেবে আনা হয় কুলদীপ যাদবকে। প্রায় একই ধরনের ডেলিভারিতে ফাইন লেগ উড়িয়ে মারতে ক্যাচ কুলদীপের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন ফাঁদে পড়ে।
সাউথ আফ্রিকার উইকেটকিপার ব্যাটারকে ফিরতে হয় ৩১ বলে ৩৯ রানের ইনিংস খেলে। ডি কক ফিরলেও স্পিনারদের বিপক্ষে রীতিমতো তাণ্ডব চালাতে থাকেন ক্লাসেন। বিধ্বংসী এই ব্যাটারের ছক্কার উত্তাপ সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছেন অক্ষর। ১৫তম ওভারে এসেছে ২৪ রান। আগের ওভারে কুলদীপ দিয়ে গেছেন ১৪ রান। সব মিলিয়ে সেই ওভারে প্রোটিয়ারা রান করেছে ৩৮। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে মাত্র ২৩ বলে পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন ক্লাসেন। যদিও হাফ সেঞ্চুরির পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তিনি।
হার্দিক পান্ডিয়ার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে পান্তের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়েছেন। ক্লাসেনকে ফিরতে হয় ২৭ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে। নিজের শেষ ওভারে বোলিংয়ে এসে জেনসেনকে বোল্ড করেছেন বুমরাহ।
পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই ব্যাট হাতে ছন্দে নেই বিরাট কোহলি। তবে ফাইনালে নিজের শুরুটা করলেন মার্কো জেনসেনের প্রথম ওভারে তিনটি চার মেরে। পরের ওভারে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে রোহিত নিজেও টানা দুই চার মারলেন। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি ভারতের অধিনায়ক। কেশভ মহারাজের ঝুলিয়ে দেয়া ডেলিভারিতে সুইপ করতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লাসেনের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন রোহিত। দারুণ ছন্দে থাকা এই ব্যাটার ফিরেছেন ৯ রানে।
একই ওভারে সাজঘরে ফিরেছেন পান্তও। মহারাজের লো ফুলটস ডেলিভারিতে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে টপ এজ হয়ে উইকেটকিপার ডি ককের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়েছেন। ভারতের এই উইকেটকিপার ব্যাটার এদিন রানের খাতাই খুলতে পারেননি। কোহলি এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেই আউট হয়েছেন সূর্যকুমার যাদবও। কাগিসো রাবাদার ব্যাক অব লেংথ ডেলিভারিতে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগের উপর দিয়ে খেলতে গিয়ে ক্লাসেনের ক্যাচ দিয়েছেন। সূর্যকুমার ফিরেছেন ৩ রানে।
৩৪ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয় অক্ষরকে। পাঁচে নেমে কোহলিকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের বিপর্যয়ে পড়া ইনিংস মেরামত করেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে ৩৪ বলে তারা দুজনে জুটির পঞ্চাশ করেছেন। হাফ সেঞ্চুরির খুব কাছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত রান আউটে কাটা পড়তে হয়েছে অক্ষরকে। রাবাদার বলে ফ্লিক করেছিলেন কোহলি। তবে ব্যাটে-বলে সেভাবে না হওয়ায় বল যায় উইকেটের পেছনে।
রান নিতে চেয়ে ফিরে যান অক্ষর-কোহলির দুজনই। তবে নন স্ট্রাইক প্রান্তে ফিরতে গিয়ে আলসেমি করে ফেলেছিলেন অক্ষর। তাতে ডি ককের সরাসরি থ্রোতেরান আউট হয়ে ফিরতে হয় তাকে। সেমিফাইনালে বল হাতে নায়ক বনে যাওয়া এই অলরাউন্ডার এদিন ব্যাটিংয়ে করেছেন ৩১ বলে ৪৭ রান। অক্ষর না পারলেও হাফ সেঞ্চুরি করেছেন কোহলি। অ্যানরিখ নরকিয়ার বলে এক রান নিয়ে ৪৮ বলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসরের প্রথম পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন ডানহাতি এই ওপেনার।
হাফ সেঞ্চুরির পর বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন কোহলি। পরের ১১ বলে ২৬ রান করেছেন তিনি। দারুণ ব্যাটিং করতে থাকা কোহলিকে ফেরান জেনসেন। বাঁহাতি এই পেসারের ব্যাক লেংথের স্লোয়ার ডেলিভারিতে লং অনের উপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন ৭৬ রানে। দুবেও খেলেছেন ১৬ বলে ২৭ রানের ইনিংস। তাদের ব্যাটেই ১৭৬ রানের পুঁজি পায় ভারত। সাউথ আফ্রিকার হয়ে দুটি করে উইকেট নিয়েছেন নরকিয়া ও মহারাজ।