বিসিএস টার্গেট অধিকাংশেরই ।।

bcs-20230726042857.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক ঢাকা প্রতিনিধি :-  বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্মুক্ত জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করাই বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালগুলোর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ৮৯ দশমিক ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী চাকরির পড়াশোনা করছেন। এর মধ্যে অধিকাংশেরই টার্গেট বিসিএস চাকরি। সম্প্রতি ঢাবি, জবি, জাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার পর্যবেক্ষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, অনার্স শেষে চাকরির জন্যই তাদের ছুটতে হয়। সেজন্য একাডেমিক পড়ালেখায় কম গুরুত্ব দিয়ে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে শিক্ষাবিদরা মনে করেন, সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি এক অনিবার্যতা হিসেবে ধরে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। দেশের শিক্ষার দুর্বল মানের কারণেই শিক্ষার্থীরা চাকরির পড়াশোনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসমূহ সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২২ জুলাই দুপুর ২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন প্রায় ৯০০। এর মধ্যে লাইব্রেরির বই পড়েন ১০ জন, চাকরির বই পড়েন ৮৮০ জন, পত্রিকা পড়েন ১০ জন। অর্থাৎ, ৯৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী চাকরির পড়াশোনা করেন।

২৪ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ৫০০ জন পড়াশোনা করছিলেন। একাডেমিক পড়াশোনা করছেন ১৩৫-১৬৫ জন। বাকি ৩৭৫-৪০৫ শিক্ষার্থী চাকরির পড়াশোনা করছেন। অর্থাৎ, ৬৭ থেকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী চাকরির জন্য পড়ছেন।

২৩ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মোট পড়াশোনা করেছেন ৩৫০ জন। এর মধ্যে ৩১০ শিক্ষার্থী চাকরির পড়াশোনা করছিলেন। ১০ জন পত্রিকা পড়ছেন; বাকি ৩০ জন একাডেমিক ও লাইব্রেরির বই পড়ছেন। অর্থাৎ, মোট ৮৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী চাকরির পড়া পড়ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুলতানুল আরেফিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে আমাদের সরকারি চাকরির জন্যই ছুটতে হয়। মাস্টার্স শেষে কোন বিষয়ে পড়েছি, এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কী চাকরি করছি। এর জন্য এখন থেকে নিজেকে সেভাবে তৈরি করছি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বলেন, তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর থেকে চাকরির পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছি। সিনিয়র থেকে পরামর্শ পেয়েছি। ক্যাডার হতে হলে এ সময় থেকে সিরিয়াস হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা প্রয়োজন— এসব বিষয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সব বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এখানে কে কোন বিষয়ে পড়বেন, তা তারাই নির্ধারণ করবেন। এখন দেখা যাচ্ছে, বাজার আর নব্য উদারবাদের প্রবক্তারা বাজারবান্ধব শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে। এজন্য ব্যবসা প্রশাসন অথবা আইসিটি গুরুত্ব পায়, দর্শন বা ইতিহাস অবমূল্যায়িত হয়। কয়েক দশক থেকে সরকারি চাকরিপ্রাপ্তি এক অনিবার্যতা হিসেবে ধরে নিচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী যতনা তাদের পাঠ্য বিষয়ে মনোযোগী, তার চেয়ে বেশি বিসিএস পাসের চেষ্টায় রয়েছেন। বাস্তবতা বিবেচনায় এদের দোষ দেয়া যায় না, দোষটা তাদের যারা ৫০ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে সে পর্যায়ে নিতে পারেননি— যে পর্যায়ে পৌঁছালে আপনাকে এ প্রশ্নটি করতে হতো না। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো, যা পশ্চিমের অনেক শিক্ষাবিদকেও ভাবাচ্ছে, তা হলো— একজন প্রকৌশলী যদি সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন সম্পর্কে কিছুই না জানেন বা একজন সাহিত্যের শিক্ষার্থী যদি পরিবেশবিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে না জানেন, তাহলে শিক্ষার উদারনীতির স্পর্শ তাদের মধ্যে পড়বে না। তারা শুধু তাদের বিষয়ের কাজে আসবেন, সমাজের কাজে তাদের বিশেষ সংযুক্তি থাকবে না। একজন শিক্ষার্থী যে বিষয় নিয়েই পড়ুন, ভালোভাবে তা পড়লে, বিশেষজ্ঞ জ্ঞান লাভ করলে এবং আরও কিছু বিষয় পড়লে তিনি জীবনের জন্য তৈরি হবেন, বাজারও তাকে মান্য করবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আলোকপ্রাপ্ত মানুষ তৈরি করা, তার মনের জানালাগুলো খুলে দেয়া, তাকে জীবন ও জীবিকার জন্য তৈরি করা।

শিক্ষার মান বাড়ানোর কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল ইসলাম মামুন বলেন, আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা আফিমের মতো সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন। এই চাকরিগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই পছন্দ পুলিশ, প্রশাসন, টেক্স ক্যাডার। এর কারণ এই চাকরিগুলোতে ক্ষমতা, নিরাপত্তা ও অবৈধ আয়ের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরিতে স্বল্প আসন। কিন্তু আমাদের বেসরকারি অনেক সেক্টর আছে, যারা উচ্চ বেতনের চাকরি দিচ্ছে; অথচ তারা যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিসিএস গাইড না পড়ে নিজেদের অন্যান্য দক্ষতা ও মান তৈরি করতে পারলে পড়াশোনা শেষে তাদের বেকার থাকতে হতো না। এ অবস্থার জন্য দায়ী দেশের সরকার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মান এত নিচে নেমে গেছে যে, তারা অন্যান্য সেক্টরে চাকরির সুযোগ করে নিতে পারছে না। এর থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। বিসিএস পরীক্ষার মান বাড়াতে হবে। যাতে ওই চাকরি না পেলেও বেসরকারি সেক্টরের অন্যান্য চাকরির জন্য নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে।

Share this post

PinIt
scroll to top