অনুমোদন ছাড়াই চলছে সাতক্ষীরার ১০৪ বেসরকারি ক্লিনিক

-অধিদপ্তর-1.jpg

সাতক্ষীরায় আগাছার মতো গজিয়ে উঠছে অনুমোদনবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নিয়ম না মেনে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুমোদনহীন এ সকল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দীর্ঘ বছর ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। দালালের খপ্পরে পড়ে নাম সর্বস্ব এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন গ্রামের সহজ সরল সাধারণ মানুষ। এছাড়া অনুমোদনহীন অনেক ক্লিনিকের বিরুদ্ধে রয়েছে চোরাচালানী ও অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ।

গত ৫জুন আশাশুনি উপজেলার কুল্যার মোড়ে অবস্থিত মা সার্জিক্যাল ক্লিনিক নামের একটি অনুমোদনহীন ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশ ১০০কাটুন ফেমিকন (জন্মবিরতিকরণ ট্যাবলেট)সহ ক্লিনিকের মালিক কথিত ডা. তরুণ কুমার মন্ডলকে গ্রেপ্তার করে।

অভিযোগ রয়েছে কথিত ডা. তরুণ কুমার মন্ডল বাংলাদেশি এসব ওষুধ সরকারি হাসপাতালের নার্স ও কর্মচারীদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে ভারতে পাচার করে থাকেন। এছাড়া ওই ক্লিনিকে রুগির ছদ্মবেশে চলে অবৈধ ব্যবসা। নারীদের দিয়ে করানো হয় অনৈতিক কাজ। শুধু মা সার্জিক্যাল ক্লিনিক নয়, এরকম অভিযোগ রয়েছে কথিত ডা. তরুণের কাকা বিধান মন্ডল পরিচালিত শহরের একটি ক্লিনিকের বিরুদ্ধেও।

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালুর আগে পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স, স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য থাকতে হয় প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, যন্ত্রপাতি। শুধু তাই নয়, ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালুর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নিতে হয়। ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের নামে ভ্যাট ও টিন সার্টিফিকেট থাকতে হয়। ক্লিনিক থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু করতে হলে অব্যশই পরমাণু রেডিয়েশনের ছাড়পত্র লাগে। সকল নিয়ম অনুযায়ী আবেদন বৈধ হওয়ার পর প্রতি অর্থবছরে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তা নবায়ন করতে হয়।

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলার সাত উপজেলায় ১২৫টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তথ্য আছে সিভিল সার্জনের কাছে। এর মধ্যে ১০৪ টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বৈধ কোন কাগজপত্র নেই। বৈধ কাগজ নিয়ে চলছে মাত্র ২১টি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান। একই সাথে এই ১২৫টির ক্লিনিকের তথ্যর বাইরে শতাধিক ক্লিনিক শহরের আনাচে কানাচে, হাটে মোড়ে, অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান চলতি বছর নবায়নের জন্য আবেদন করলেও কাগজপত্র সঠিক না থাকায় তাদেরকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। জেলার তালিকাভুক্ত ১২৫টির ভিতর ২১টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সকল কাগজপত্র সঠিক আছে বলে জানিয়েছে সিভিল সার্জন। বাকিগুলোর বৈধ কাগজপত্র নেই। অবৈধ ক্লিনিকগুলো চলে বিশেষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও রাঘব বোয়ালদের শেল্টারে।

মালিক পক্ষের পোষা দালালের খপ্পরে পড়ে অনুমোদন বিহীন এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে এসে অপচিকিৎসা প্রাপ্তির পাশপাশি স্বর্বশান্ত হচ্ছে অনেক গরীব ও অসহায় রোগীরা। এভাবে অবৈধ এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবার নামে চলছে প্রতারনা।

সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা শহরের অবস্থিত লাইসেন্স বিহীন ১৩টি ক্লিনিকগুলোর মধ্যে রয়েছে সানজানা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, একতা হাসপাতাল, রায়হানা স্যার্জিকাল ক্লিনিক, ডিজিটাল মেডিকেল সেন্টার, এম আলী পলি ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নাজ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেডিকেয়ার প্যাথলজি সেন্টার, নিউ লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বাঁকাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, একতা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেঘনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেডিনোভা ডায়াবেটিক এন্ড কার্ডিয়াক সেন্টার, আস্থা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

শ্যামনগরে ১৪টি ক্লিনিকের মধ্যে রয়েছে কাশিমাড়ী ডিজিটাল ক্লিনিক, আল শেফা হাসপাতাল, ড. আনসার আলী হাসপাতাল, আনিকা প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্রেগনেন্ট কেয়ার ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডাক্তার খান ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আল বারাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মডেল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নুরনগর ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডক্টরস ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মুন্সিগঞ্জ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফ্যামিলি কেয়ার ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার, কাশিমাড়ী ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার উল্লেখযোগ্য।

কালিগঞ্জে ৭টি ক্লিনিক হলো, ইউনিক ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নুর নগর ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মৌতলা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলথ কেয়ার ডিজিটাল ল্যাব, খায়রুনেচ্ছা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফ্যামিলি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস, আলোর দিশা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডিজিটাল ল্যাব।

আশাশুনিতে ৩টি ক্লিনিকের মধ্যে রয়েছে তাজ ক্লিনিক, হাইকেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক ল্যাব, সোনার বাংলা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

কলারোয়া উপজেলার ১৪টির মধ্যে আছিয়া মেমোরিয়াল নার্সিং হোম, জনসেবা ক্লিনিক, সবুজ ক্লিনিক, সোনাবাড়িয়া নার্সিং হোম এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পল্লী সেবা ক্লিনিক, জননী নার্সিং হোম, কাজিরহাট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডা. আ. হাকিল স্যার্জিকাল ক্লিনিক, খোরশেদ পল্লী সেবা কেন্দ্র, স্টার প্যাথলজি সেন্টার, ই-ল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নোভা ডিজিটাল ল্যাব, ইভা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গাজী ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

তালায় রয়েছে ৫টির মধ্যে রয়েছে পপুলার ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জননী নার্সিং হোম, এ আর ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, তালা ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং দেবহাটায় ৩টি হলো, কুলিয়া ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সিটি ডিজিটাল ল্যাব এন্ড ক্লিনিক ও মেডিপয়েন্ট ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক।

এছাড়া আগে থেকে লাইসেন্স রয়েছে কিন্তু নবায়নের জন্য কয়েকবছর ধরে আবেদন করেনি সদরে এমন ক্লিনিক রয়েছে ১১টি। এগুলো হলো স্বপ্ন ক্লিনিক, স্বপ্না ক্লিনিক, স্বপ্না ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্বদেশ ক্লিনিক, সাতক্ষীরা স্যার্জিকাল ক্লিনিক, নিরাময় ক্লিনিক, নিরাময় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শিমুল মেমোরিয়াল ক্লিনিক, শিমুল মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এম আলী পলি ক্লিনিক ও সুন্দরবন ক্লিনিক।

শ্যামনগরের শামিমা ক্লিনিক ও আরজি নার্সিং হোম, কালিগঞ্জের যমুনা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কলারোয়ায় মায়ের হাসি নার্সিং হোম এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সাকিব মেমোরিয়াল ক্লিনিক ও কলারোয়া নার্সিং হোম, তালার স্বাগতা ক্লিনিক এবং দেবাহাটার হাবিবা স্যার্জিকাল ক্লিনিক, মোমেনা হাসপাতাল প্রাঃ ও গাজী স্যার্জিকাল ক্লিনিক।

লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে কিন্তু কাগজপত্র সঠিক ও সকল ডকুমেন্টস না থাকার কারণে অনুমোদন দেয়া হয়নি এমন ক্লিনিকগুলোর মধ্যে রয়েছে সদরের ক্রিস্টাল হাসপাতাল, সোনালী ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলথ কেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, করবী ডা. এন্ড কনসালটেশন সেন্টার, সাতক্ষীরা গাইনী হাসপাতাল, আনোয়ারা ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার ও জয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আশাশুনিতে ডক্টরস ক্লিনিক ও কালিগঞ্জে নলতা ডায়াবেটিক এন্ড জেনারেল হাসপাতালে লিঃ, ডা. হয়রত আলী ডিজিটাল ল্যাব এন্ড হাসপাতাল।

এদিকে সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেশ কয়েকজন ডাক্তার ও কর্মচারী এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে সরাসরি জড়িত থাকায় ক্লিনিক পরিচালনা করার জন্য তাদের কোন নিয়মকানুন মানা লাগেনা। অনেক ক্ষেত্রে দালালদের মাধ্যমে এসব ক্লিনিক পরিচালনা করা হয়। আবার শহরে প্রচার আছে যে, সিভিল সার্জন অফিসের একজন বড়বাবুর প্রত্যক্ষ শেল্টারে এসব অবৈধ ক্লিনিকের অনেক গুলো পরিচালিত হয়। বিনিময় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মাশহারা পেয়ে থাকেন তিনি। অভিযানে জেলা শহর বা উপজেলায় কোন ক্লিনিক সিলগালা করে দেয়া হলে কয়দিন পরেই তিনি সেটি খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। যে কারণে এরা বৈধ কাগজপত্র করতে খুব বেশি আগ্রহী থাকেনা। এমন অভিযোগ সদর হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর।

এছাড়া অনুমোদনবীহিন এসব ক্লিনিকে ধার করা খন্ডকালীন চিকিৎসক দিয়ে চলছে জটিল অস্ত্রোপচারসহ নানা চিকিৎসা। ফলে এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় সময়ই ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও উঠে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে নেই অ্যাম্বুলেন্স, নেই এনেস্থিয়া ডাক্তার, নেই অক্সিজেন সরবরাহের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এখানে নেই প্রশিক্ষিত নার্স। তবুও প্রশাসনের নাকের ডগায় দাপটের সাথে চলছে এসব প্রতিষ্ঠান।

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, সাতক্ষীরা চিকিৎসা বাণিজ্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কিছু রাঘব বোয়াল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় এগুলো চলে আসছে। মাঝে মাঝে অভিযান হয়, থেমেও যায়। কিছু ক্লিনিক বন্ধ হয়, কয়দিন পর আবার তা চারু হয়। কাজেই এই অভিযান কেন হয়, আবার কেন থেমে যায় আমরা আজও বুঝতে পারিনে।

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম বলেন, আমি সাতক্ষীরা নতুন এসেছি। আগের সিভিল সার্জন কি করেছে এর দায়ভার আমি নিব না। আমি যোগদানের পর কয়েকদিন আগে বেসরকারি ক্লিনিক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশন সাথে বসেছি। আগামী ১জুলাই থেকে সকল ক্লিনিক পরিদর্শন করব। কাদের লাইসেন্স নেই, কারা নবায়ন করেনি, সেটা দেখা হবে। কোন কাগজপত্র না থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

দেশের তথ্য ডেস্ক / আই এইচ

Share this post

PinIt
scroll to top