ডেঙ্গুতে নারীর মৃত্যু কেন বেশি

.webp

দেশের তথ্য ডেস্ক :- জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু। সঙ্গে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে, সেই পূর্বাভাস আমি আগেই দিয়েছিলাম। প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমণের আশঙ্কার কথাও দুই মাস আগে বলেছিলাম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য মতে, ২১ জুলাই পর্যন্ত ২৮ হাজার ৪৪৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ১৫৬ জন। তবে আক্রান্তের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। কারণ যে হিসাব পাওয়া গেছে, তা ঢাকার ৭০টি এবং অন্যান্য জেলার ৭২টি হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য।

এসব রোগীর বাইরেও অনেক রোগী ছোট-বড় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে ও নিচ্ছে। তাদের তথ্য কন্ট্রোলরুমে নেই। আবার অনেক রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের মধ্যে ৬৩.৩২ শতাংশ পুরুষ, ৩৬.৬৮ শতাংশ নারী।

তবে মৃত্যুর হার পুরুষের তুলনায় নারীর বেশি। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৫৭.৪২ শতাংশ নারী, ৪২.৫৮ শতাংশ পুরুষ। মারা যাওয়া নারীর মধ্যে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী প্রায় ৭০ শতাংশ। এটি উদ্বেগজনক। নারীর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সঠিক কারণ জানা গেলে প্রতিকার সম্ভব।

বাংলাদেশে নারীর ডেঙ্গুতে উচ্চ মৃত্যুহার নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা নেই। এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে আমাদের গবেষকদল। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে মৃত্যুর কারণগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ডেঙ্গুতে নারীর মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে যেসব বিষয় পাওয়া গেছে সেগুলো তুলে ধরা যাক।

নারীর ক্ষেত্রে অপুষ্টি ও রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এ কারণে যেকোনো ভাইরাল ইনফেকশনে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। আর গর্ভবতী ও ঋতুস্রাবকালীন শারীরিক দুর্বলতাও একটি অন্যতম কারণ। এ ছাড়া নারীর মধ্যে দ্রুত চিকিৎসাসেবা নেওয়ার প্রবণতা কমের পাশাপাশি নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে রয়েছে উদাসীনতা। আবার বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি অবহেলার কারণে দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নারীর মৃত্যু বেশি। চিকিৎসক, গবেষক, রোগী ও পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যে এমন চিত্রই মিলেছে।

ডেঙ্গুর এই সময়টায় পরিবারের অভিভাবকদের অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে। মৃত্যুর হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চারজনের মধ্যে তিনজনই ভর্তির দু-এক দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে।

ডেঙ্গুতে নারীর মৃত্যু বেশি হলেও আক্রান্তের হার পুরুষের বেশি (৬৩.৩২ শতাংশ)। স্ত্রী মশার পেটে যখন ডিম আসে তখন সেটির প্রধান খাদ্য রক্ত। আর এই সময়টায় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ স্ত্রী মশার শিকার হয় বেশি। অনেক কারণে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষকে বেশি কামড়ায় মশা। এই বয়সী পুরুষের বিপাক প্রক্রিয়া অন্য বয়সী পুরুষের তুলনায় দ্রুত হয়। এ ছাড়া পুরুষ নড়াচড়া বেশি করায় শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে ঘাম তৈরি হয়ে দেহ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। মশা কার্বন ডাই-অক্সাইডে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষকে বেশি কামড়ায়। আবার নানা কাজে পুরুষকে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। এসব কারণেও মশার কামড় ও মশাবাহিত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি পুরুষের বেশি।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারী বা পুরুষ কারো ক্ষেত্রেই অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বর হলে তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে ডেঙ্গু হলো কি না। যদি ডেঙ্গু হয় তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিতে হবে।

সামনের দিনগুলোয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে সম্মিলিতভাবে এডিস মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বাড়ি ও বাড়ির আঙিনায় পানি জমে যাতে এডিস মশা প্রজনন করতে না পারে প্রত্যেককে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে চলে আসবে।

লেখক : কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক ও অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Share this post

PinIt
scroll to top