দেশের তথ্য ডেস্ক।।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলেরা আশায় ছিলেন, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে এবার প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। কিন্তু দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা পাঁচ দিন আগে শেষ হলেও নদ-নদী কিংবা সাগরে প্রত্যাশিত ইলিশ ধরা পড়ছে না। ফলে কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা না পেয়ে হতাশ জেলেরা। সাগর থেকে খালি ট্রলার নিয়ে জেলেরা ঘাটে ফিরছেন মলিন মুখে।
মাছঘাটগুলোতে শ্রমিকরাও অলস সময় কাটাচ্ছেন।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টি না হওয়ায় বর্তমানে নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম। তাই মিলছে না ইলিশের দেখা। তবে ইলিশ ধরা পড়বে।
এর জন্য জেলেদের কিছু সময় ধৈর্য ধরতে হবে। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমে নদীর পানি শীতল হবে। এর পরের পূর্ণিমা থেকেই ইলিশের দেখা মিলবে।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইলিশ রক্ষায় প্রতিবছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশের অভয়াশ্রমে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার।
২০০৬ সাল থেকে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস নদ-নদীর বিস্তীর্ণ সীমাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ছয়টির মধ্যে পাঁচটি অভয়াশ্রমে ৩৯২ কিলোমিটার জলসীমা রয়েছে। এই সীমার মধ্যে থাকা নদীগুলো হচ্ছে মেঘনা, কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ, নয়ভাঙ্গুলী, গজারিয়া ও কীর্তনখোলার কিছু অংশ।
অন্যদিকে পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকায় দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা পালিত হয় ১ নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অভয়াশ্রমগুলোতে শুধু ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
তবে অন্য মাছ ধরার অসিলায় নদীতে নেমে যাতে ইলিশ নিধন করা না যায় সে জন্য সব ধরনের জেলে নৌকা এ সময় পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকে।
বরিশালের পোর্টরোড মোকামের আড়তদার জহির উদ্দীন জানান, গত বছরও এই সময়ে দিনে ৫০০ মণ ইলিশ আসত। সেখানে বর্তমানে দিনে ৪০ মণ ইলিশও আসছে না। প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে না। ফলে ইলিশের দেখা মিলছে না।
নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়ার কারণ হিসেবে বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বঙ্কিম চন্দ বলেন, গত বছর আর চলতি বছরের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। গত বছর এত তাপমাত্রা ছিল না। এবার অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে নদ-নদীর পানি গরম থাকায় উজানে ইলিশ কম আসায় ধরা পড়ছে না।
তার মতে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসকে ইলিশের মূল মৌসুম ধরা হয়। মে-জুন-জুলাইকে ধরা হয় ‘ডাল সিজন’ হিসেবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদনে হেরফের হচ্ছে।
বরিশাল আবহাওয়া বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছর বরিশাল অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়নি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাস ছিল বৃষ্টিহীন। মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলেও এপ্রিলে আবার অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। তবে সামনে বৃষ্টি হলে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
বৃষ্টি না হলে ইলিশের দেখা মেলে না
বঙ্গোপসাগরতীরের পাথরঘাটার মানুষ আফসার মাঝি। তিন যুগের বেশি সময় ধরে গভীর সমুদ্রে ইলিশ ধরছেন। বাতাসের গতি-প্রকৃতি আর আকাশ দেখে ইলিশ শিকারে যান। বাতাসের গতি আর আকাশ দেখেই বলে দিতে পারেন মাছের উপস্থিতি।
আফসার মাঝি বলেন, ‘ইলিশ হলো ঝাঁকের মাছ। একটা জালে বাধলে অন্যরাও তেড়েফুঁড়ে এসে ঢোকে। যখন বাধে না তখন একটাও বাধে না। পানির রং দেখে মাঝি জাল ফেলার স্থান নির্ধারণ করেন। সাদা ও সবুজ পানিতে মাছ বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি হলে সাগরের কোনো কোনো জায়গা সাদা বর্ণ ধারণ করে। বৃষ্টির মিঠা পানি সমুদ্রের লোনা পানির সঙ্গে যখন মেশে, তখন তা ইলিশ মাছকে খুব আকর্ষণ করে। সে পানিতে মাছের গায়ে চর্বি জমে, আর পেটে আসে ডিম। বৃষ্টি না হলে মাছ লুকিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। তাকে তখন খুঁজে পাওয়া জেলের সাধ্যের বাইরে।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে যখন বৃষ্টিপাত বেশি হয়, পানির স্রোত বেড়ে যায়, তখন ইলিশের পরিমাণ বেশি হয়। এখন যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত শুরু হয়, তাহলে ইলিশ আসা শুরু করবে। এ ছাড়া ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম অক্টোবর-নভেম্বর মাস সামনে। তখন হয়তো পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে আমাদের বর্ষা মৌসুমে এখন হেরফের হচ্ছে। ইলিশের প্রজনন, উৎপাদনেও তাই হেরফের হচ্ছে।’