দরিদ্র ও কোটিপতি দুই-ই বাড়ছে, কেন?

imtiaz-mahmud-poverty-20240328102530.jpg

বাংলাদেশকে এখন তো আর কেউ দরিদ্র দেশ বলতে পারবে না। ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত এক লাখ সাড়ে তেরো হাজার কোটিপতি ছিল। বিবিসি এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে এই সংখ্যাটা এসেছে ব্যাংক একাউন্টে রক্ষিত টাকার হিসাবে। ধরে নেওয়া যায় যে এই টাকাটা প্রায় পুরোটাই সাদা টাকা। কালো টাকার হিসাব ধরলে আর সম্পদের হিসাব যুক্ত করলে হয়তো এই সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে।

এর প্রতিফলন আপনি দেখতে পাবেন দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে পণ্যের ধরন ও কেনাবেচার হার দেখলে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামের হিসাব তো আছেই, এছাড়া দেশে দামি গাড়ি থেকে শুরু করে সব বিলাসবহুল পণ্য বিক্রির হিসাব নিলে দেখা যাবে যে, চাওয়া মাত্রই টাকা বের করে দিতে পারবে এই রকম লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। সেই সাথে যদি বিবেচনায় নেওয়া হয় দেশের সাধারণ প্রবৃদ্ধি, গড় আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি তাহলে গরিব দেশ বলার তো আর উপায় থাকেই না।

এইরকম অবস্থার মধ্যে যখন সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব দেয় যে, দেশের শতকরা ২৬ ভাগ পরিবারকে মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য ঋণ করতে হয় তখন দৃশ্যপটটা কী দাঁড়ায়? এটা কেমন দেশ আর কেমন তার অর্থনীতি যেখানে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি অথচ প্রতি চারটি পরিবারের একটি ওদের মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ খাবার-দাবার, জামা-কাপড় কেনা, চিকিৎসার খরচ, আবাসন শিক্ষা এইসব খরচ মেটাতে পারে না নিজেদের আয় থেকে!জরিপ পরিচালনা করেছে সরকারের সংস্থা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এটা ছিল বাংলাদেশে সরকারিভাবে করা খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রথম জরিপ। জরিপের ফলাফলটা জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশিত হয়েছে। এই জরিপ প্রসঙ্গে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে যে, সংখ্যাটি ২৬ শতাংশের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা। এই ২৬ শতাংশের মধ্যে বেশিরভাগই গ্রামের মানুষ।

খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাতে মানুষকে ঋণ করতে হচ্ছে, ঋণের শতকরা ৬৮ ভাগই মানুষ নিচ্ছে এনজিও থেকে অতি উচ্চসুদে। বাকিটা আসে আত্মীয়স্বজন, ব্যাংক ও অন্যান্য উৎস থেকে। পরিসংখ্যানেই এসেছে যে, এইসব দরিদ্র মানুষ বছরে গড়ে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ বা তারচেয়ে খানিকটা বেশি করে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। বলাই বাহুল্য, গ্রামের এইসব মানুষের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ঋণগ্রস্ত, তার উপর এইসব ঋণ মানুষকে এমন একটি ঋণের জালে ঠেলে দেবে যেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে যাবে।

এমন না যে, দেশে খাদ্যের সেই রকম কোনো অভাব আছে। দেশে চালের কোনো সংকট নেই, অন্যান্য খাদ্যশস্যেরও কোনো সংকট নেই। তেল, লবণ, চিনি, আটা, ময়দা, শাকসবজি, মাছ, মাংস সবই আছে বাজারে। কিন্তু সব পণ্যেরই মূল্য অনেক বেশি—এত বেশি যে আমাদের মধ্যবিত্তের পক্ষেও বাজারের সাথে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এই দামে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক খাবার কিনে, সন্তানের শিক্ষা বা চিকিৎসা ব্যয় বহন করা বা কাপড়চোপড় কেনা যে কঠিন হয়ে যাবে তা তো স্পষ্ট।

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাজার ভর্তি খাবার, গুদাম ভর্তি খাবার, বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে খাবার, দেশের নির্দিষ্ট অংশের মানুষ সেইসব খাবার কিনছেও প্রতিদিন, কিন্তু কম বেশি প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মানুষ সেইসব খাবার কিনতে পারছে না, দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারছে না। এটা কেন হয়?

এটা তো রাজনৈতিক কারণে হচ্ছে। খাবারের অভাব নেই, অভাব নেই অন্য কোনো পণ্যের, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার জন্য আমরা সব মানুষের জন্য এইসব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারছি না। বেসরকারি সংস্থাগুলো অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য ঋণের জোগান নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে তো দেশের প্রতি চারজন মানুষের একজনকে অভুক্ত থাকতে হবে।

এটা যদি বাস্তব অবস্থা হয় তাহলে—একদিকে কোটিপতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে আর আরেকদিকে কিছু মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে না। এটা তো কোনো আদর্শ পরিস্থিতি হতে পারে না। সংকটটা আসলে রাষ্ট্র যেসব নীতির ভিত্তিতে চলছে সেইখানে।

এই প্রসঙ্গে বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত Poverty and Famines: An Essay on Entitlement and Distribution গ্রন্থের কথা উল্লেখ করতে হয়। (এই রচনার জন্যেই অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন)। লেখকের আলোচনার বিষয় ছিল সাধারণভাবে মানুষের নিরন্ন অবস্থা এবং বিশেষভাবে দুর্ভিক্ষের কারণ।

আমাদের দেশের ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, যেটা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত, বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৭০-এ ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ এইসব কয়টা বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। এরপর তিনি যেটা দেখিয়েছেন তা হলো, খাদ্যের স্বল্পতার জন্য বা খাদ্যের অভাবের জন্য মানুষ অভুক্ত থাকে না বা দুর্ভিক্ষ হয় না। দুর্ভিক্ষ হয় মূলত রাজনৈতিক কারণে—আমাদের পঞ্চাশের মন্বন্তর বা ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বা সত্তরের দশকে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ কোনোটাই খাদ্যের অভাবের কারণে হয়নি, হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। ‘রাজনৈতিক কারণে’ কথাটা একটু সরলীকরণ মনে হতে পারে, কিন্তু অমর্ত্য সেন যেসব কারণ চিহ্নিত করেছেন তা রাজনৈতিকই বটে।

সরকারের পরিসংখ্যানই যেখানে বলছে যে, এনজিও এবং অন্যান্য উৎসের ঋণের জোগান না থাকলে দেশের ২৬ শতাংশ মানুষের জন্যে মৌলিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়তো, তখন তো আমাদের বলতেই হয় যে এটা আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা বা আমাদের অনুসৃত নীতির ব্যর্থতা। বিশেষ করে বর্তমানে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের যে বেহাল দশা, তা থেকে তো দৃশ্যতই দেখা যাচ্ছে যে বাজারের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহের কোনো ঘাটতি না থাকলেও কেবলমাত্র সরকারের অনুসৃত নীতির কারণেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য এমনকি দেশের মধ্যবিত্তেরও ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

সরকার বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করছে এবং একরকম পণ করে বসে আছে যে, বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না। ফলে বাজারে কার্যত কোনো ব্যাপক প্রতিযোগিতা না থাকায় বাজারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ীর হাতে। এই অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ীদের আমরা সকলে ‘অসাধু ব্যবসায়ী’ বা ‘সিন্ডিকেট’ এইসব নামে চিহ্নিত করছি আর দোষারোপ করছি। কিন্তু বাজারে যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকে, বাজার যদি তথাকথিত মুক্ত থাকে, তাহলে এইরকম অবস্থা তো অনিবার্য।

ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ব্যবসাবান্ধব সরকার হয়েছে, ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষের ন্যূনতম খাদ্য নিরাপত্তাটুকুও থাকছে না। আমরা যদি বাজার প্রসঙ্গে আমাদের বিদ্যমান নীতি পরিবর্তন না করি তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। কোটিপতির সংখ্যা হয়তো প্রতিদিন আরও অনেক বাড়বে, অপরদিকে অভাবও বাড়বে, দেশের মানুষের নির্দিষ্ট অংশের জন্য ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে যাবে।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

দেশের তথ্য ডেস্ক

Share this post

PinIt
scroll to top