সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শ্রীশ্রী শ্যামা পূজা আগামীকাল

20241030_194617-scaled.jpg

কয়রা প্রতিনিধিঃ অরবিন্দ কুমার মণ্ডল
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শ্রীশ্রী শ্যামা পূজা বা কালীপূজা রাত পোহালেই উদযাপিত হচ্ছে আগামীকাল। তার গায়ের রং শ্যামলা বা নীল।

দেবী কালি শিবের শক্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছলেন। হিন্দু পূরাণ অনুসারে কালী দেবীর নানা বর্ণনা আছে। মার্কণ্ডেয় পূরাণে উল্লেখ আছে, তিনি বিভিন্ন রূপে অসুরদের ধ্বংস করে স্বর্গের দেবতাদের রক্ষা করেছিলেন। ইন্দ্রসহ সকল দেবতা, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেবী অম্বিকার কাছে প্রার্থনা করেন। অম্বিকা ক্রোধে উন্মত্ত হলেন। তখন দুই রূপ হল তার অম্বিকা ও কালিকা বা কালি। শম্ভু ও নিশুম্ভের অনুচর চণ্ড ও মুণ্ডে দেবী কালী বধ করেন। এ কারণে তার আরেক নাম হয় চামুন্ডা।

খড়্গ হাতে সংসারের পাপ নাশ করেন দেবী কালিকা। উগ্র রূপে ভক্তদের কাছে ধরা দেন তিনি। খড়্গের গায়েই আঁকা থাকে চোখ। মনে করা হয় মায়ের খড়্গ অজ্ঞানতাকে দূর করে মানুষকে বোধ দান করে। আর শিয়াল বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবেই পরিচিত। তাই নিজের বুদ্ধির জোরে মা কালীর বাহন শিয়াল।

কালী পূজার মাধ্যমে আমরা আমাদের মন ও মননে ধারণ করতে পারি কোমলতা, সাহসিকতা, নৈতিকতা বোধ ও সহযোগিতা বোধ।

হিন্দু পূরাণ মতে কালী দেবী দূর্গারই একটি শক্তি। সংস্কৃত ভাষায় ‘কাল’ শব্দ থেকে কালী নামের উৎপত্তি। কালী পূজা হচ্ছে শক্তির পূজা। জগতের সকল অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভ শক্তির বিজয়ের মধ্যেই রয়েছে কালী পূজার মাহাত্ম্য। কালী দেবী তার ভক্তদের কাছে শ্যামা বা আদ্যা মা, তারা মা, ভদ্রকালী, দেবী মহামায়া ইত্যাদি নামে পরিচিত।
কালী পূজার দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সন্ধ্যায় তাদের বাড়ীতে ও শ্মশানে প্রদীপ প্রজ্বলন করে পরলোকগত পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে স্মরণ করেন। এটিকে বলা হয় দীপাবলি বা দেওয়ালি।

ঘোর অমাবস্যায় এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় বলে এই সময়ে চারিদিকে আলোর বন্যা বয়ে যায়। মোমবাতি থেকে শুরু করে প্রদীপের আলো, বিভিন্ন ধরনের লাইটিং যা প্রতিটি ঘর থেকে আশেপাশের সকল পরিবেশকে আলোকমালায় সাজিয়ে তোলে। বিভিন্ন দেবদেবীর মধ্যে দেখা যায় শ্যামা পূজা বা কালীপূজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

একদিক থেকে বিশ্বাস করা হয় যে, পৃথিবীর সকল অন্ধকার কে নিমিষেই দূর করতে এ আলোর উৎসবের আয়োজন। অশুভ শক্তির হাত থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যই আলোকমালা আমাদের সাহায্য করে। অন্ধকার রাস্তায় পথ দেখানোর জন্য আমরা যেমন আলোর ব্যবহার করি ঠিক তেমন।

কালী পূজার এই উৎসব খুব বেশি পুরানো তা কিন্তু নয়। ১৮ শতকে এই উৎসবটি বাংলার গ্রামাঞ্চলে স্বীকৃতি পায় এবং নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র এটা শুরু করেছিলেন। কালীপূজা ১৯ শতকের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি অর্জন করেছিলো। তার পাশাপাশি রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের নাতি ঈশান চন্দ্র এই পূজা উৎসবটিকে খুব বড় আকারে উদযাপন করার প্রথা শুরু করেছিলেন। আর সেই প্রথা অনুসারে এই কালীপূজা দুর্গাপূজার মতই বর্তমানে বড় আকারে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া এই শ্যামা কালী পূজা বর্তমানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাঝে বিশেষ করে গুরুত্ব সহকারে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যে পালন করে থাকে।

তবে কিংবদন্তি অনুসারে দক্ষরাজা বৃহস্পতির অমতে তার মেয়ে সতীদেবী ভগবান শিব কে বিয়ে করেছিলেন। এ কারণে দক্ষ রাজা মহাদেব শিবের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই তিনি মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। পরমেশ্বর ভগবান শিব ও সতীদেবী ছাড়া সকল দেব-দেবীকে এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। শিবের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সতী দেবী মহাদেবের অনুসারীদের নিয়ে ঐ যজ্ঞ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। বিনা নিমন্ত্রণে উপস্থিত হওয়ায় সতীকে যথাযথ সম্মান না দেওয়াসহ শিবকে বিভিন্নভাবে ভৎস্যনা সহ অপমান করেন। স্বামীর প্রতি পিতার এই অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেবী যজ্ঞের সেই আগুনে যোগ বলে নিজেকে আহুতি দেন।

এই সংবাদ মহাদেবের কানে পৌঁছালে তিনি শোকে কাতর ও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। তিনি যজ্ঞ স্থলে উপস্থিত হয়ে দক্ষ রাজার যজ্ঞ পন্ড করে দেন। এরপর সতী দেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। শিবের প্রলয় নৃত্যে মহাকাশ অন্তরীক্ষ পৃথিবী কেঁপে উঠল। সৃষ্টি রক্ষার তাগিদে তখন অন্য দেবতারা বিষ্ণুর স্মরনাপন্ন হন। অতঃপর ভগবান বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। তখন সতী দেবীর খন্ড-বিখন্ড দেহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে । পরবর্তীতে সেই স্থান গুলো শক্তি পিঠ বা তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিতি পায়। ৫১ টি খন্ড ৫১ স্থানে পড়েছিল। সেই ৫১ টি শক্তিপীঠে কালী পূজার প্রচলন হয়। সেই থেকে কালী পূজা শুরু হয় বলে অনেকের ধারণা।

এ বছর ৩১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিবা তিনটা ৩৮ মিনিটের পরে অমাবস্যা তিথি শুরু এবং সে সময় থেকে শ্যামা কালী পূজার তিথি শুরু ও ১ নভেম্বর শুক্রবার অপরাহ্ন পাঁচটা ৩৮ মিনিটের মধ্যে সমাপ্তি হবে। তবে বৃহস্পতিবার রাত রাত ১১টা২৬ মিনিট থেকে ১২টা ১৪ মিনিটের মধ্যে দীপাবলি বা দেওয়ালিতে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রদীপ ও মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে স্মরণ করা হবে।

Share this post

PinIt
scroll to top