গোপালগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
নুজহাতুল হাসান ওরফে রাজিব ওরফে তুতু। বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বাটিকামারীতে। বাবার নাম মৃত মালেক মিয়া। বর্তমানে থাকেন রাজধানীর পল্লবী এলাকায়। অভিযোগ রয়েছে, নুজহাতুল হাসান একজন ভূয়া সাংবাদিক। সাংবাদিক সেজে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করাই তার মূল পেশা। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভুয়া সমন্বয়ক সেজে ব্যবসায়ীদের ব্লাকমেইল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা রয়েছে। আগেও প্রতারণার অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জামিনে বের হয়ে পুনরায় সক্রিয় হয়েছেন চাঁদাবাজিতে।
নুজহাতুল হাসানের অপরাধের অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে বহু মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের ফিরিস্তি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চার বছর আগে দাতা সংস্থা কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ (কেএসআর)-এর কাছ থেকে কোটি চাঁদা দাবি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান, এমডি ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে কুতসা রটানোকে চাঁদা আদায়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন নুজহাতুল হাসান। অপতথ্য দিয়ে সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল কন্টেন্ট বা আধেয় নির্মাণ করে গণমাধ্যমে প্রচারের হুমকি দিয়ে তিনি হয়রানি করেন। যদিও কে বা কারা টার্গেট করে হয়রানিতে লিপ্ত হয়েছে তা জানত না দাতা সংস্থাটি।
থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, বিশাল অংকের চাঁদা দাবির ঘটনা জানিয়ে ২০২১ সালের ৩ জুন উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করে কেএসআর কর্তৃপক্ষ। মামলায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে এই ভয়ংকর প্রতারণার সঙ্গে জড়িত নুজহাতুল হাসান এবং তার ভাগিনা হাদিউজ্জামান ওরফে হেলাল। একপর্যায়ে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) জালে ধরা পড়ে হেলাল। তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। পুলিশ এই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন নুজহাতুল হাসান। আদালতে দুই বছরের সাজা হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। তার নামে ক্রিমিনাল মামলা থাকায় তার পাসপোর্ট ব্লক করে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ।
আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি উত্তরা বিভাগের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল আলম উল্লেখ করেছেন, নুজহাতুল হাসান ও তার ভাগিনা হেলাল ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পরিচয় গোপন রেখে লিখিত বার্তা এবং ভিডিও পাঠিয়ে চাঁদা দাবি করেন। তারা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে লিখিত বার্তা এবং ভিডিও পাঠিয়ে ভুক্তভোগীদের মানসিক নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং চাঁদা দাবি করে দণ্ডবিধি ৩৮৫/৩৮৭/৩৪ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (২০১৮) ২৪/২৫/২৯/৩৫ ধারাবাহিক অপরাধ করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
অনুসন্ধানী তথ্য বলছে, বেপরোয়া জীবন যাপনের জন্য অতিষ্ট হয়ে ছোটবেলায় তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় পরিবার। বাবা, মা ও ভাইয়েরা পর্যন্ত বিরক্ত তার অপকর্মে। একপর্যায়ে রাজধানীতে বস্তির অসামাজিক পরিবেশে বড় হওয়া এই নুজহাতুল হাসান জাল জালিয়াতিতে সিদ্ধহস্ত। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সব প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট জাল। মূলত তার পেশা প্রতারণা। তবে নিজেকে পরিচয় দেন সাংবাদিক। মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নুজহাতুল হাসানের বিশ্বস্ত সহযোগী তারই স্ত্রী। দুজন মিলে টার্গেট করা ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপতথ্য দিয়ে ডিজিটাল কন্টেন্ট বা আধেয় নির্মাণ করে তাদের হোয়াটসআপে পাঠান। পরে তা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করেন তারা। অনেকে ভয়ে টাকা দিতেন আবার অনেকে দিতেন না। যারা টাকা দিতেন না তাদের নানাভাবে হয়রানি করতেন। এভাবে সাংবাদিকতার আড়ালে চলত তার অপরাধ জীবন।
এসব নিয়ে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হলে, দুই বছর আগে ভাইয়েরা তাকে পুনর্বাসনের জন্য বাড়িতে নিয়ে যান। কিছুদিন পর সেখান থেকে পালিয়ে আবার ঢাকায় চলে আসেন তিনি। পুনরায় ব্লাকমেলিং ব্যবসা শুরু করেন নুজহাতুল হাসান। মিরপুরেও একটি চাঁদাবাজির অভিযোগে ডিবি আটক করলে স্ত্রীসহ শ্বশুড়বাড়ির লোকজন এসে ভালো আচরণের শর্তে মুচলেকা দিয়ে নুজহাতুল হাসানকে ছাড়িয়ে নেন।
একাধিক সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন দিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন নুজহাতুল হাসান। দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পরপর সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মানুষের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে চাঁদাবাজি করছেন। তিনি ভয়ংকর চাঁদাবাজ চক্রে জড়িত। জঘন্য এই অপরাধী সাংবাদিক বেশ ধারণ করে মানুষকে হয়রানি করে যাচ্ছেন এবং অবৈধ উপায়ে টাকা হাতানোর ঘৃণ্য লিপ্সায় মেতে উঠেছেন। এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময় সুযোগ নিয়ে এবং ভুয়া সমন্বয়ক সেজে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তির নামে মিথ্যা মানহানিকর গুজব প্রচার করে হয়রানিসহ চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ছোট বেলাতেই কুলাঙ্গার আখ্যা দিয়ে নুজহাতুল হাসানকে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাবা-মা। তার ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, তাদের সঙ্গে বর্তমানে নুজহাতুল হাসানের কোনো যোগাযোগ নেই। তার অপরাধ বিষয়ে তারা ওয়াকিবহাল। আইনিভাবে কখনও প্রয়োজন হলে নুজহাতুল হাসানের অপরাধ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই।
তার বিষয়ে জানতে চাইলে নুজহাতুল হাসানের বড়ভাই নাজমুল বাপ্পী বলেন, তার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। সে তার মতো থাকেন। তার বিরুদ্ধে নানান সময় নানান অভিযোগ শুনেছি। এগুলো বলে লাভ নেই। আমার ভাই খারাপ প্রয়োজনে সাক্ষী দিবো কেউ ডাকলে।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে নুজহাতুল হাসান রাজিবের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে, সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কল কেটে দেন তিনি। এরপর মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায় তার।
তার বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার এসআই কামরুল ইসলাম বলেন, তুতুর নামে থানায় কয়েকটি জিডি রয়েছে। সেগুলো তদন্তাধীন রয়েছে। জিডিগুলো বেশিরভাগই প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভয়ভীতি সংক্রান্ত।
ভুক্তেভোগীদের দাবি, তুতুর প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে চান তারা।