ফেনী প্রতিনিধি
ফেনী সদর উপজেলার দুই বন্ধু শাখাওয়াত হোসেন পিন্টু ও গিয়াস উদ্দিন মিলে পোলট্রি মুরগির খামার গড়ে তুলেছিলেন। নিজেদের সব সম্পদ বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যাংক ও বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন তিনটি ফার্ম; যেখানে প্রায় ১০ হাজার মুরগি ছিল।
উদ্যোক্তা এই দুই তরুণ, খামারের পাশাপাশি মুরগির খাবারের মিলও গড়েছিলেন। তিনটি ফার্ম আর মিল মিলিয়ে স্থানীয় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করেছিলেন তারা। স্বপ্ন ছিল, একদিন এই খামার তারা আরও বড় করবেন; যাতে এলাকার শিক্ষিত যুবকদের আর বাইরে চাকরি করতে যেতে না হয়।
কিন্তু স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পিন্টু-গিয়াসের সেই স্বপ্ন ভেসে গেছে। তারা এখন প্রায় নিঃস্ব; উপরন্তু ঘাড়ে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ঋণ। এখন কীভাবে এই ঋণ পরিশোধ করবেন, আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি-না এই দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে তাদের।
সদর উপজেলার বড় ধলিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাখাওয়াত হোসেন পিন্টু বুধবার বিকালে বলছিলেন, “আকষ্মিক বন্যায় সড়ক সংলগ্ন খামারে পাঁচ ফুট উপরে পানি উঠে যায়। খামারে থাকা লেয়ার মুরগি ও ডিম দেওয়ার উপযোগী হওয়া মুরগি মরে গেছে। প্রায় ১০ হাজার মুরগির মধ্যে বুধবার দুপুর পর্যন্ত মাত্র ৩২৯টি বাচ্চা মুরগি জীবিত আছে। সেগুলোও এখন মরছে।
“খামার সংলগ্ন মুরগির ফিড তৈরির একটি মিল ছিল। মিলে ৩০ টন ভূট্টা, সায়াবিন, পামওয়েল ছিল। সব মিলিয়ে দুই কোটি টাকার উপরে মূলধন ছিলো। বন্যায় সব ভেসে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছি।”
এসব মুরগির মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার ডিম দেওয়া লেয়ার, চার হাজার (৭০ দিন বয়েসি) মুরগির বাচ্চা এবং হাজারখানেক মাংসের মুরগি ছিল।
সদর উপজেলার মোল্লার তাকিয়া গ্রামের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বলছিলেন, “ব্যবসায় মূলধনের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ ছিলো। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২২ লাখ, আনসার-ভিডিপি ব্যাংকে নয় লাখ, ব্র্যাক এনজিও ১৫ লাখ ও আশা এনজিও থেকে চার লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। ভাই, এখন একদিকে ঋণ পরিশোধ আর অপরদিকে বাঁচার চিন্তা।”
চলমান বন্যায় পিন্টু-গিয়াসের মত আরও অনেক মানুষ পথে বসে গেছে। এ বছর বন্যায় সারাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে পূর্বাঞ্চলের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর জেলা। এর মধ্যে বন্যার তীব্রতা, ক্ষয়ক্ষতি অন্য তিন জেলার তুলনায় ফেনীতে অনেক বেশি।
প্রায় দুই সপ্তাহ পরেও ফেনীতে এখনো লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে দিনযাপন করছেন। গ্রামীণ জনপদ থেকে এখনো পানি নামেনি। বন্যার এই ভয়াবহতার কারণেই সারাদেশ থেকে যত ত্রাণ গেছে তার বড় অংশ গেছে ফেনীর বানভাসি মানুষের জন্য।
যেসব জায়গা থেকে বন্যার পানি সরে গেছে সেখানে ভেসে উঠছে ক্ষত। রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছেড়ে বাড়ি ফিরেও দেখছেন তার মাথা গোজা ঠাঁই বিলীন হয়ে গেছে।
এ ছাড়া প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা হাজারো পোলট্রি ফার্ম নষ্ট হয়ে গেছে। গৃহপালিত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি হারিয়ে লাখো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, এবারের বন্যায় প্রাণিসম্পদ খাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এটা প্রাথমিক হিসাব। ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
খামারিরা বলছেন, এবারের বন্যায় ফেনী জেলার দুই হাজারের বেশি খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শেষ সম্বল হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। ঋণের দায়ে পথে বসতে হবে অনেককে।
ফখরুলের গেছে ৫০ হাজার মুরগি
সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের বাঘাইয়া গ্রামের প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম মাসুক। প্রকৌশলী হয়েও চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজে কিছু করার স্বপ্ন থেকে ২০০৯ সালে একটি পোলট্রি খামার দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
নিজের মেধা ও যোগ্যতায় পর্যায়ক্রমে ব্যবসা বড় হয়। আশপাশের এলাকায় ১৫টি মুরগির খামার ও একটি মাছের প্রকল্প গড়ে তোলেন ফখরুল। একাই এলাকার শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।
ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে ফখরুলের সবকটি খামার ও মাছের প্রকল্প। এতে তার দেড় কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
ফখরুল ইসলাম মাসুক বলেন, “ধার-দেনা, ব্যাংক ঋণ ও নিজের সঞ্চয় দিয়ে তিলে তিলে ব্যবসা গড়ে তুলেছিলাম। বন্যায় খামারের ৪০ হাজার সোনালি মুরগি, ১০ হাজার লেয়ার মুরগি মরে গেছে। ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সব খামার। দুই গুদামে থাকা ১৫ লাখ টাকার মুরগির খাদ্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।”
আলমগীর হোসেন নামে ফুলগাজীর আরেক খামারি বলেন, “বন্যার ১৫ দিন আগে খামারে মুরগি তুলেছিলাম। আকষ্মিক বন্যায় কোনো কিছুই সরাতে পারিনি। দেড় হাজার মুরগি, সঙ্গে খাবারসহ অন্যান্য সব জিনিসপত্র পানিতে ভেসে গেছে।
“কোনোভাবেই এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব না। এখন যদি সরকার আমাদের মতো খামারিদের স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ দেয় তাহলে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।”
সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের আলোকদিয়া গ্রামের কাজি বাড়ির বাসিন্দা আবুল হোসেন। অফিস সহায়ক হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি বাড়িতে দুধের একটি গাভী পালন করতেন। বন্যায় তার লাখ টাকা মূল্যের গাভীনটি (গর্ভবতী ও সাত দিনের মধ্যে বাচ্চা দিত) মরে গেছে।
ঘুরে দাঁড়াতে সমাজের বিত্তবানদের কাছে অন্তত একটি বাছুর দাবি করেছেন আবুল হোসেন।
আবদুর রাজ্জাক নামে আরেকজন কৃষক বলেন, “তিনটি গরু লালন-পালন করে কোনোমতে অভাবের সংসার সামলে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ এ বন্যায় সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারলেও গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি বন্যার পানিতেই রেখে যেতে হয়েছে। পানি নামার পর বাড়ি ফিরে এগুলোর আর কিছুই পাইনি।”
গরু-মহিষই মরেছে প্রায় ৩৯ হাজার
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, বন্যায় জেলার প্রাণিসম্পদ খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি নয় লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ছিল ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। জেলায় ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬৩টি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।
ছয় উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩৮ হাজার ৭৩১টি গরু, ৩৫৯টি মহিষ, ১৫ হাজার ৫৮৮টি ছাগল ও ৭৩৬টি ভেড়া মারা গেছে।
এ ছাড়া ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১০টি মুরগি ও এক লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২টি হাঁস মারা গেছে। মৃত পশুপাখির মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৮ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩০ টাকা।
এক হাজার ৯৯২টি গবাদি পশুর খামারের ১৩ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা এবং এক হাজার ৬২৩টি হাঁস-মুরগির খামারের ১০ কোটি ৯৭ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তিন হাজার ৯৫০ টন পশুপাখির দানাদার খাবার বিনষ্ট হয়েছে যার বাজারমূল্য ২৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জেলায় তিন কোটি ৮১ লাখ টাকার খড়, তিন কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকার পশুপাখির ঘাস বিনষ্ট হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ২৮৫ একর চারণভূমি।
খামারিদের সহায়তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, বন্যা পরবর্তী এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওষুধ ও খাদ্য। জেলায় গত কয়েকদিনে ৫০০ কেজি পশুখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।
“ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। কোনো ধরনের প্রণোদনা অথবা সহায়তা এলে তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করব।”