তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন উদারপন্থি নীতিমালা

image_100158_1719731282.webp
দেশের তথ্য ডেস্কঃ
সরকারের ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নীতি, বিশেষ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য নীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ও অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো তামাকের ব্যবহার ও এর ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে নানা উদ্যোগের পক্ষে কাজ করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণের উপায়/কৌশল প্রণয়নে যুক্ত থাকায়, এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।

তামাকের ব্যবহার কমাতে ও স্ব্যস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, ধূমপান কমানোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিভিন্ন উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক প্রভাবে ফেলছে। বিশ্বজুড়ে মানুষকে তামাক বর্জন করে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনতে নানা কৌশলের পক্ষেও তারা কাজ করে যাচ্ছে।

তবে, ধূমপানের নিরাপদ বিকল্প প্রসঙ্গে তাদের নিজেদের মধ্যে সম্প্রতি মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। তারা প্রচলিত তামাক নিয়ন্ত্রন পদ্ধতির পক্ষে কথা বললেও, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘ধূমপান ছাড়ো, নয়তো মরো (কুইট অর ডাই)’ উপায়ের বিকল্প হিসেবে বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকর পদ্ধতিগুলোর ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার না।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, দাহ্য তামাকপণ্যের তুলনায় অদাহ্য তামাকপণ্য কম ক্ষতিকারক। এই গবেষণার প্রেক্ষিতে এমন প্রশ্নও উঠেছে যে, যারা চিরতরে ধূমপান বর্জন করতে চান তাদের জন্য এই বিকল্পগুলি আসলেই তামাকের ক্ষতিহ্রাসের কৌশল/উপায় হিসেবে সহায়ক হবে কি না।

লরেঞ্জো মাটা জুনিয়র-এর তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত ফিলিপাইনভিত্তিক একটি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ‘কুইট ফর গুড’ (Quit for good), ইলেক্ট্রনিক সিগারেটের (ই-সিগারেট) এর ব্যাপারে বিশ্বের প্রথম সারির স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোর অবস্থান নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও, ধূমপায়ীরা বিগত দুই দশকে ধোঁয়াবিহীন বিকল্প পণ্য ব্যবহার করার ফলে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যে যে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তাতে জোর দেন লরেঞ্জো মাটা জুনিয়র।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র অবস্থানের বিপরীতে গিয়ে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য (যা দাহ্য সিগারেটের বিকল্পগুলিকে ধূমপান বর্জনের কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে) উল্লেখ করে মাটা জুনিয়র বলেছেন, ই-সিগারেটের উপর সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ধূমপান দূর হওয়ার বদলে বরং আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। তিনি আরও বলেন, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বহু দেশ ধোঁয়াবিহীন পণ্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রমাণভিত্তিক নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছে, যা ফলতঃ বিকল্প পণ্যের মাধ্যমে ধূমপায়ীদেরকে ধূমপান ত্যাগ করতে সহায়তা করেছে। প্রমাণভিত্তিক নীতি-নির্ধারণের পাশাপাশি দাহ্য তামাকপণ্য ও কম ক্ষতিকর তামাকপণ্যের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন মাটা জুনিয়র।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, সকল তামাকজাত পণ্যকে একই কাতারে ফেলার সুযোগ নেই। দাহ্য হবার কারণে তামাকজাত পণ্যের মধ্যে সিগারেটকে বরাবরই সবচেয়ে ক্ষতিকারক হিসেবে বিবেচনা হয়। অপরদিকে, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ও ইলেক্ট্রনিক সিগারেট আছে ধোঁয়ামুক্ত তামাকপণ্যের তালিকায়, যাতে ক্ষতিকারক উপাদানের মাত্রাও খুব কম। হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ও ইলেক্ট্রনিক সিগারেটের মূল পার্থক্য এদের কাঁচামালে। ই-সিগারেটে ব্যবহার করা হয় নিকোটিনযুক্ত সলিউশন, আর হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টে থাকে তামাকজাত উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) উভয়ই নিকোটিন ধারণ করলেও এদের গঠনে ভিন্নতা রয়েছে। হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টের মধ্যে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত তামাকের কিছু উপাদান থাকে।

ই-সিগারেটগুলো প্রায় ১৫৫০০ ফ্লেভারসমৃদ্ধ গন্ধসার তেলের দ্রবণ দ্বারা গঠিত, যার মধ্যে অনেকগুলো বিষাক্ত, স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, বিস্ফোরণের ঝুঁকিও থাকতে পারে এবং দ্রবণে অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ মিশ্রিত হতে পারে। তবুও, বিশদ বৈজ্ঞানিক গবেষণামতে, এগুলো প্রচলিত তামাকজাত পণ্যের তুলনায় ৯০ শতাংশ কম ক্ষতিকর।

ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাডভোকেসি গ্রুপের তৎপরতা মাটা জুনিয়রকে বিস্মিত করেছে। ধূমপায়ীরা ধোঁয়াবিহীন বিকল্পগুলি বেছে নেয়ার ফলে যে ক্ষতিকর উপাদানের ঝুঁকি হ্রাস পাচ্ছে, অ্যাডভোকেসি গ্রুপের পদক্ষেপগুলো যেন সেটিকে আমলেই আনছে না -এমনটাই আশঙ্কা করেছেন তিনি। এ ধরণের নিষেধাজ্ঞার কারণে অবৈধ বেচা-কেনা, এমনকি কালোবাজারিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, যা জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় রাজস্বের জন্য হতে পারে আরও ক্ষতিকর।

লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের টোব্যাকো ডিপেন্ডেনস রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক পিটার হায়েক এবং নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজি বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক জন ব্রিটন-এর মত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন ধূমপানজনিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধোঁয়াবিহীন পণ্য সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এছাড়া, তারা ধোঁয়াবিহীন বিকল্প পণ্যের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পক্ষেও মত দিয়েছেন।

যেহেতু বাংলাদেশ একটি তামাকমুক্ত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তামাকমুক্ত দেশ গড়ার এই লক্ষ্য অর্জনে সকল তথ্য-প্রমাণ, কৌশল ও ক্ষতিহ্রাসের বিকল্পের দিকে নজর দেয়া ভীষণ জরুরি। জাতিগতভাবে আমাদের উচিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নীতির খুঁটিনাটিগুলো গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করা এবং একইসাথে বিশ্বমানের জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা।

তামাক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কার্যকরিতা মূল্যায়নে, বিশেষত কম ক্ষতিকারক বিকল্পের মাধ্যমে তামাকের ঝুঁকি হ্রাস করতে উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এ ধরণের আরও কিছু স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোর নির্দেশনা থেকে যে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোকে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে ও সমসাময়িক প্রমাণের প্রেক্ষিতেই বিবেচনায় নিতে হবে। তামাকমুক্ত সমাজ গড়ার এই রূপকল্পের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কৌশল প্রণয়নে নানা অংশীজন অর্থাৎ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নীতি-নির্ধারক এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে উদার মানসিকতা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনায় অংশগ্রহণ করা তাই একান্ত আবশ্যক।

Share this post

PinIt
scroll to top