ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে যেসব মিল আপনাকে বিস্মিত করবে!

image_99663_1719577899.webp

দেশের তথ্য ডেস্কঃ

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক ইস্যুতেই আলাদা। কিন্তু কিছুটা কাছ থেকে দেখলে আপনি দেখতে পাবেন যে, মূলত দুই প্রার্থীর মধ্যেই বৈদেশিক নীতি, বাণিজ্য এবং এমনকি অভিবাসন নীতি নিয়েও কিছু আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে।

যদিও সিএনএন-এ বৃহস্পতিবারের প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের সময় আপনার দুজনের এই মিলের বিষয়ে খুব বেশি কিছু শোনার সম্ভাবনা নেই। এটি সর্বোপরি একটি বিতর্ক। বরং এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যকার এবারের বিতর্ক হতে পারে স্মরণকালের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনের মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রসূ বিতর্কগুলোর একটি। ভবিষ্যৎ কমান্ডার ইন চিফ হিসাবে দুই প্রার্থীর মধ্যে তুলনা করার সময় ভোটারদের তাদের মেজাজ, ধারাবাহিকতা এবং কোন বিষয়ে অনুমান করার যোগ্যতার বিষয়গুলোও বিবেচনা করা উচিত। সর্বোপরি, আমেরিকার মিত্র এবং প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিশ্বের নেতৃস্থানীয় পরাশক্তির সাথে মোকাবিলা করার সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধারণা পেতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা অবজ্ঞা নয়, বরং তারা সম্মানজনক আচরণ প্রত্যাশা করেন। এই প্রচেষ্টার একটি চমৎকার উদাহরণ হলো- চলতি বছরের শেষ নাগাদ ন্যাটোর সকল সদস্য জিডিপির ২ শতাংশ তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষায় ব্যয় করবেন। এটি ওবামা প্রশাসনের সময় একটি নীতিগত লক্ষ্য ছিল, যখন বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু আপনি জানেন না যে, প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ট্রাম্প কিভাবে ক্রমাগত ন্যাটো সদস্যদের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে প্রকাশ্যে তিরস্কার করেছিলেন। তিনি মিথ্যা দাবি করেছিলেন যে, ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে যারা ২ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি, তাদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক বিলিয়ন ডলার ‘পাওনা’ ছিল।

জার্মানির মতো আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের ট্রাম্প ভুলভাবে সমালোচনা করেও তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সূঁচ পরিমাণও নড়াতে পারেননি। কিন্তু এটি অবশ্যই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জার্মানদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। ২০১৮ সালে মাত্র ১১ শতাংশ জার্মান ট্রাম্পের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছিল। এ ছাড়া, Pew/Körber ফাউন্ডেশনের একটি জরিপ অনুসারে, তার শাসনামলে সাধারণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও ২০ শতাংশ কমে যায়। এ ছাড়া, আমেরিকান নীতিতে দ্রুত পরিবর্তন করেন তিনি। যেমন, ট্রাম্প প্রকাশ্যে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উনের জন্য তার ‘ভালোবাসা’র কথা ঘোষণা করেছেন। অথচ, দেশটি কয়েক দশক আগে থেকেই আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠার পাশাপাশি মার্কিন মিত্র, এমনকি চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্যও অস্থিরতার সৃষ্টি করে। চীন উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসকের নামমাত্র মিত্র হতে পারে, কিন্তু কিমের বিস্তৃত পারমাণবিক এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং তার পারমাণবিক মেজাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া চাইনিজদের জন্য অস্বস্তিকর।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের ২১ শতকের বৈদেশিক নীতির মূল ইস্যুটি কী হবে এ ব্যাপারে বাইডেন এবং ট্রাম্পের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। ট্রাম্প তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্টদের চেয়ে চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। চীনের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটি রাজনীতিতেও উদারীকরণ করবে বলে দীর্ঘদিনের যে বিশ্বাস ছিল, ২০১৭ সালে ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে সেই বিশ্বাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে আসা হয়। বরং তার পরিবর্তে, ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে একটি সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বিবেচনা করা শুরু করে এবং অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত “দ্য কোয়াড” এর মতো ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদারিত্বকে সংকুচিত করা শুরু করেন। ট্রাম্প চীনা পণ্যের উপর বিপুল শুল্ক আরোপ করেন, যা উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

অনুমান করুন তো, এরপর কি ঘটেছিল? যখন বাইডেন হোয়াইট হাউসে পৌঁছেন, তিনি তখন ট্রাম্পের চেয়েও দ্বিগুণ শুল্ক আরোপ করেন। তিনি আগের আরোপিত শুল্ক বজায় রাখার পাশাপাশি নতুন করে চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ১০০% করারোপ করেছিলেন। চীনা সামরিক বাহিনী যাতে লাভবান না হয়, সেজন্য বাইডেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কম্পিউটার চিপসের মতো খাতে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করেন। ২০২২ বাইডেন সিক্সটি মিনিট (60 minutes) কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, চীন আক্রমণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে রক্ষা করবে। এর মধ্যদিয়ে তাইওয়ান সম্পর্কে আমেরিকার দীর্ঘদিনের “কৌশলগত অস্পষ্টতা” নীতি পরিত্যাগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ, দ্বীপটিতে আক্রমণ করলে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া কি হবে সে বিষয়ে এতদিন চীন কেবল ধারণার ওপরই নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন গোয়েন্দারা মূল্যায়ন করেছেন যে, মাও সেতুং এর পর সবচেয়ে শক্তিশালী চীনা নেতা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার সেনাবাহিনীকে তাইওয়ানে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।

গাজা যুদ্ধ

এরপর মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া যাক, যেখানে গাজা যুদ্ধ চলছে। পূর্বে, ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে তেল আভিভে থাকা মার্কিন দূতাবাস বিতর্কিত জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করার মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া হয়। এতে বিক্ষোভকে উস্কে দেওয়া হয় এবং কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। কারণ, ইসরায়েলিদের মতো ফিলিস্তিনিরাও বিশ্বাস করে যে, জেরুজালেমই তাদের রাজধানী। ক্ষমতায় থাকাকালীন, ট্রাম্প ইসরায়েলকে অন্ধভাবে পশ্চিম তীরে কেবল বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ করতে দেওয়াই নয়, বরং তিনি ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ডেভিড ফ্রিডম্যানকে নিযুক্ত করেছিলেন। ফ্রিডম্যান দীর্ঘস্থায়ী মার্কিন নীতির বিপরীতে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে, ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের কার্যকলাপ বেআইনি। এমনকি ইসরায়েল যদি পশ্চিম তীরের কিছু অংশকে দখলও করে নিত, সেটিও ট্রাম্প প্রশাসন সমর্থন করত।

এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পারিবারিক বন্ধু -ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার আব্রাহাম অ্যাকর্ডস চুক্তি নিয়ে মধ্যস্থতা করেছিলেন, যা ইসরায়েল এবং কিছু আরব রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। কিন্তু ওই চুক্তি ফিলিস্তিনিদের কিছুই দেয়নি।

অন্যদিকে, বাইডেন প্রশাসন আব্রাহাম অ্যাকর্ডস চুক্তির আসন্ন সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণকে অন্তর্ভুক্ত করে। যা ৭ই অক্টোবর হামাসকে ইসরায়েলে হামলা চালাতে আংশিক প্ররোচিত করেছে বলে মনে করা হয়। হামাসের ওই হামলার দুই সপ্তাহ আগে এক বিরল এক সাক্ষাৎকারে সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো শাসক ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান ফক্স নিউজকে বলেন, ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য “প্রতিদিনই আমরা নিকটবর্তী হচ্ছি”।

অক্টোবরে একটি প্রচারাভিযানের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, হামাস এই ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিককরণকে ব্যাহত করতে চেয়েছিল। মূলত নেতানিয়াহুর সঙ্গে হতাশা বাড়তে থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলি নেতাকে ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনাহীন আলিঙ্গনকে অব্যাহত রাখে বাইডেন প্রশাসনও। এমনকি, নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেনের সমর্থনের নিজস্ব নামও রয়েছে “দ্য বিয়ার হাগ”। বাইডেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মাঝে মধ্যে গাজায় হতাহতের মাত্রা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন এবং দীর্ঘদিন নেতানিয়াহুর সাথে কথাবার্তাও বন্ধ ছিল। কিন্তু ইসরায়েলের প্রতি তাদের শক্তিশালী সমর্থন অব্যাহত ছিল। বরং এই সমর্থনকে আরও স্পষ্ট করতে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের কাছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের এফ-ফিফটিন( F-15) যুদ্ধবিমান বিক্রির জন্য এগিয়ে যাচ্ছে।

হামাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে ইসরায়েল যে বোমা ব্যবহার করেছে তার অনেকই সরবরাহ করেছে মার্কিন সরকার। ঠিক একইসময়ে, অনাহারে থাকা গাজাবাসীদের সহায়তা পেতে সাহায্য করার জন্য ভূমধ্যসাগরে আমেরিকার নির্মিত ও বহুল প্রচারিত ঘাটটি ছিল একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা। এমন একটি যুদ্ধের কথা মনে করা কঠিন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একইসাথে যুদ্ধবাজদের একজনকে বিপুল অস্ত্র এবং অন্য পক্ষকে ত্রাণ সরবরাহ করেছে।

ইরান এবং সৌদি আরব

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফর ছিল সৌদি আরবে, যেখানে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। কারণ তার ইরানবিরোধী অবস্থান সৌদি স্বার্থের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল। ট্রাম্প ২০১৮ সালে ইরানের সাথে ওবামা প্রশাসনের করা পারমাণবিক চুক্তি প্রত্যাহার এবং দুই বছর পরে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে একটি ড্রোন হামলায় ইরানের অন্যতম প্রধান সামরিক নেতা মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন। কারণ ট্রাম্পের মতে, সোলেইমানি “শত শত আমেরিকান বেসামরিক নাগরিক এবং সেনাদের লক্ষ্যবস্তু, আহত এবং হত্যা করেছিলেন।”

বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এখন এমবিএস (বিন সালমান) এর প্রতি আস্থা রাখেন, কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তির রাস্তা রিয়াদের মধ্যস্থতায়ই সম্ভব, যদি ইসরায়েলি এবং সৌদি আরব দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান নীতির কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়। অন্যদিকে, ইরানের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার কিছু প্রাথমিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বাইডেন প্রশাসন চুক্তিটি নবায়ন করেনি। এই বছরের শুরুর দিকে জর্ডানে তিনজন আমেরিকান সৈন্যকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় বাইডেন একটি ড্রোন হামলার অনুমোদন দেন, এতে বাগদাদে ইরান-সমর্থিত এক মিলিশিয়া নেতা নিহত হয়।

সিরিয়ায় ইসরায়েলিরা একজন শীর্ষ ইরানী জেনারেলকে হত্যার পর, বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক জোটের নেতৃত্ব দেয়। ইরান প্রতিশোধ হিসেবে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শত শত ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। যদিও ওই হামলা ইসরাইলে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়নি। (সংক্ষেপিত)

Share this post

PinIt
scroll to top