ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর অহরহ, দেখার কেউ নেই!

image_99434_1719494050.webp

দেশের তথ্য ডেস্কঃ

ডাক্তারের প্র্যাকটিসের জন্য প্রতি মাসে একজন করে রোগীর প্রাণ যাচ্ছে। অনেকেই আবার ছোট রোগের চিকিৎসা নিয়ে হচ্ছেন বড় রোগে আক্রান্ত। এসব অভিযোগ সাতক্ষীরার নলতার বেসরকারি শেরেবাংলা ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। আর লাইসেন্সবিহীন এই ক্লিনিকে রোগীদের ভুল চিকিৎসা দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশের মালিক ডাক্তার তানিয়া সুলতানা।

অভিযোগ রয়েছে বিশেষজ্ঞ না হয়েও তিনি প্র্যাকটিসের জন্য করছেন ভুল চিকিৎসা। সর্বশেষে তার ভুল চিকিৎসায় বুধবার (২৯ জুন) বিকেলে নূর জাহান বেগমের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। নূরজাহান বেগম দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী।

ভুল চিকিৎসায় নিহত নূর জাহান বেগমের ছেলে মো. সুমন বলেন, চলতি বছরের শুরুতে আমার মা জরায়ুর ক্যান্সার ধরা পড়ে। তার কয়েকদিন পরে আমার মায়ের পেটে যন্ত্রণা শুরু হলে নিকটস্থ শেরে বাংলা ক্লিনিকে চিকিৎসা করাতে যাই। ওই ক্লিনিকের ডাক্তার তানিয়া সুলতানা ম্যাডাম মায়ের বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপারেশনের জন্য ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অপারেশন করলে আপনার মা শতভাগ সুস্থ হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে অপারেশন না করলে আপনার মায়ের মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

তখন আমি সাতক্ষীরার দুজন ডাক্তারের বক্তব্য তাকে জানাই। তবুও তিনি বলেন, এসব বিষয়ে সাতক্ষীরা ডাক্তারদের কোনো ধারণাই নেই। মায়ের ব্যথা যন্ত্রণার কারণে আমি দিশাহারা থাকায় কী করব ভেবে না পেয়ে ডা. তানিয়া সুলতানা ম্যাডামের কথায় ৩২ হাজার টাকায় অপারেশনের জন্য রাজি হই। তিনি আমাকে মায়ের শতভাগ সুস্থতা নিশ্চিতের আশা দেন।

সুমন বলেন, মায়ের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় ক্লিনিকে যোগাযোগ করলে আমাকে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক ওই ক্লিনিকে আর না যাওয়ার জন্য আমাকে শাসিয়ে ছেড়ে দেন। পরে মায়ের জরায়ু দিয়ে রক্ত ক্ষরণ শুরু হলে স্থানীয় কিছু লোকজনের সহায়তায় ওই ক্লিনিকে যাই এবং ক্লিনিক মালিক এবং ডাক্তার আমাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি না করে আমাদেরকে বের করে দেন। উপায়ান্ত না পেয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার সার্জারি বিভাগের ডাক্তার মো. মোনয়ার হোসেন স্যারকে দেখাই। তিনি আমাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিও থেরাপি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন এবং পূর্বের সমস্ত রিপোর্ট দেখে অপারেশন ভুল হয়েছে বলে আমাকে জানান।

সুমন আরও বলেন, ডাক্তার তানিয়া সুলতানার ভুল চিকিৎসার কারণে কয়েক মাস মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বুধবার বিকেলে আমার মা মারা গেছেন। আমিসহ আমার পরিবার এই ডাক্তারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তানিয়া সুলতানা শুধু এমবিবিএস ডাক্তার। এর বাইরে তার কোনো বিষয়ের উপর ডিগ্রি বা ট্রেনিং নেই। তবে তিনি সিজার, জরায়ু অপারেশন, গলার টনসিল অপারেশনসহ প্রাই সব রোগের চিকিৎসা দেওয়াসহ অপারেশন করে থাকেন। আর এসব অপারেশনে লাগে না কোনো অজ্ঞানের ডাক্তার। তানিয়া সুলতানা একাই করেন সব কাজ। নিয়ম অনুযায়ী একজন ডাক্তার একটি ক্লিনিক অথবা হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু ডাক্তার তানিয়া সুলতানা একাই ৩টি প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে তিনি শ্যামনগর নগর হাসপাতাল, নলতা শেরেবাংলা ক্লিনিক ও দেবহাটা সখিপুর গাজী সার্জিকাল ক্লিনিকের মেডিকেল অফিসারের দায়িত্বে আছেন।

এদিকে, গত ২৯ মে শেরে বাংলা ক্লিনিকে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় কারণে রক্তশূন্যতায় হাবিবা বেগম নামে এক গৃহবধূ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে- রোগীটি ডাক্তার তানিয়ার ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। এ ছাড়া দেবহাটা উপজেলার সুসিলগাদির মৌসুমি বেগম (২৮) নামের এক গৃহবধূ শেরেবাংলা ক্লিনিকে ডাক্তার তানিয়ার ভুল চিকিৎসায় বর্তমানে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন।

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডাক্তার সুব্রত ঘোষ বলেন, একজন এমবিবিএস ডাক্তারের যদি কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞ কিংবা ট্রেনিং না থাকে তাহলে সে সাধারণ চিকিৎসার বাইরে কোনো ধরনের অপারেশন করতে পারে না। সাতক্ষীরায় এমন অনেক ডাক্তার রয়েছে, যাদের এমবিবিএস এর বাইরে কোনো ট্রেনিং বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে অভিজ্ঞতা নেই। তবুও তারা রোগীদের নিয়মিত বিশেষজ্ঞ সেজে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। এসব ডাক্তারের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিতে তিনি প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানান।

অপরদিকে, অভিযোগ রয়েছে গত মাসের ১০ তারিখে শেরেবাংলা ক্লিনিক গলার টনসিল অপারেশন করতে আসা ফিরোজা বেগম নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। অভিযোগ রয়েছে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ডাক্তার মো. শাহীন রেজা গলার টনসিল অপারেশন করতে গিয়ে ভুলবশত শ্বাসনালি কেটে ফেলায় ফিরোজা বেগমের মৃত্য হয়।

এসব বিষয়ে অভিযুক্ত শেরে বাংলা ক্লিনিকের একাংশের স্বত্বাধিকারী ও অভিযুক্ত ডাক্তার তানিয়া সুলতানা বলেন, আমি নিয়ম অনুযায়ী রোগীদের যেটুকু চিকিৎসা দিতে পারি সেটুকুই দিয়ে থাকি। রোগীরা অসুস্থ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন, কেউ ভুল চিকিৎসায় মারা যায়নি।

একজন মেডিকেল অফিসার একই সঙ্গে ৩টি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সকালে শ্যামনগর এবং বিকেল থেকে নলতায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এর বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি চুক্তিবদ্ধ নেই। আমি মনে করি এটা সঠিক।

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. আব্দুস সালাম বলেন, নলতার শেরে বাংলা ক্লিনিকের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে বিষয়টি আমি অবগত আছি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে

Share this post

PinIt
scroll to top