দিঘলিয়ায় নূর ইসলাম শেখ পলিনেট হাউজে বিষমুক্ত সবজি চাষে সফল

441909968_3781745372071344_895475093247914038_n.jpg

শেখ শামীমুল ইসলাম, দিঘলিয়া (খুলনা) প্রতিনিধিঃ জলবায়ু ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি বিজ্ঞানের নতুন উদ্ভাবন ‘পলিনেট হাউজ’ খুলনার কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিষমুক্ত ও কীটনাশক ছাড়াই সারা বছর নানা রকম উচ্চমূল্যের সবজি উৎপাদন করতে পারছেন কৃষকরা। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নের লাখোহাটি গ্রামে এমনই একটি প্রকল্প আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। এই চাষ পদ্ধতি কৃষির উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সবজি চাষের জন্য দেশের অন্যতম উপযোগী খুলনা জেলার মাটি। প্রতি বছর এ জেলায় হাজার হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন রকম শাকসবজি, মসলা জাতীয় ফসল, ফলমূলের চাষ করেন কৃষকরা। তবে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানামুখী হুমকির মুখ থেকে কৃষি খাতও বাদ পড়েনি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষি নির্ভরশীল। তাইতো কৃষিকে বাঁচাতে নতুন নতুন গবেষণা শুরু করেছে সরকারের কৃষি বিভাগ। তারই ধারাবাহিকতায় কৃষি বিভাগে আবির্ভাব ঘটেছে একটি সময়োপযোগী বালাইমুক্ত বিষমুক্ত উৎপাদন পদ্ধতি ‘পলিনেট হাউজ’। এর মাধ্যমে শীতকালীন সবজি যেমন গ্রীষ্মকালে উৎপাদন করা যাবে, তেমনি গ্রীষ্মকালের সবজিও শীতের মৌসুমে উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যে কোনো আবহাওয়ায় এ পদ্ধতির উৎপাদনের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে না। হাতের মুঠোয় নতুন এই প্রযুক্তি চলে আসায় কৃষককে কোনো বেগ পেতে হবে না। প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারি বৃষ্টি, তীব্র দাবদাহ, পোকামাকড়, ভাইরাসজনিত রোগের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিরাপদ থাকবে সবজি। দিতে হবে না কোনো কীটনাশক। দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়নের লাখোহাটি গ্রামের কৃষক মোঃ নূর ইসলাম শেখকে পলিনেট হাউজ নির্মাণ করে দিয়েছে কৃষি বিভাগ (বিএডিসি খুলনা)। আর তার এই কৃষিক্ষেত্রে এগিয়ে আসার পিছনে সীমাহীন অবদান রেখেছেন বর্তমান কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার শীলা, পাশাপাশি অবদান রেখেছেন দিঘলিয়া উপজেলা কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তাগণ। এ পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে ক্যাপসিকাম, টমেটো, ব্রোকলি, স্কোয়াশ, স্ট্রবেরি, মেলন, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুসসহ বিভিন্ন শাকসবজি। এর দৈর্ঘ্য ১৩ শতক। এর চারপাশ নেট দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে, যাতে কোনো পোকামাকড় ঢুকতে না পারে। এতে উন্নত মানের পলিপেপার ব্যবহার করা হয়েছে। লোহার অ্যাঙ্গেলের ওপর পলিপেপার দিয়ে শেডে এই পলিনেট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। রয়েছে পানি সেচ দেয়ার আধুনিক প্রযুক্তি। কৃষক নূর ইসলাম শেখ ২৫ বছর ধরে কৃষি কাজ করে আসছেন। তার জমির পরিমাণ ১ একর। তিনি কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জনের কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ত্কো সাফল্যের প্রতীক হিসেবে ক্রেস্ট পদক ও নগদ টাকা উপহার হিসেবে দিয়েছেন। এ পলি নেট হাউজ তৈরি ও স্থাপনের জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পুরো খরচ দেয়া হয়েছে তাকে। তবে এই টাকা আর শোধ দিতে হবে না। কৃষিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে আরো যদি সহযোগিতা লাগে কৃষি বিভাগ তা দিবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এ পদ্ধতিতে ফসল চাষে ব্যাপক লাভের আশা নূর ইসলাম শেখের। নূর ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে ২০২৩ সালে আমাকে বিনামূল্যে পলিনেট হাউজ নির্মাণ করে দিয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দেখতে আসে এটি। এই সবজি হাউজে আমি ক্যাপসিকাপ, টমেটো, ব্রোকলি, স্কোয়াশ, স্ট্রবেরি, মেলন, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপি,, লেটুসসহ বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করছি। কিছু সবজির চারাও রোপণ করেছি। এতে কোনো সার-কীটনাশক দিতে হয় না। চারদিকে ঘিরে দেয়ায় কোনো পোকামাকড়ও ঢুকতে পারে না। নিরাপদভাবে এ পদ্ধতিতে উচ্চমূল্যের সবজি চাষ করে লাভবান হওয়ার আশা করছি। তিনি আরও বলেন এ পদ্ধতিতে সারা বছর ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। ২০/২৫ হাজার টাকা ইনভেস্টে ২/২.৫ মাসে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার ফসল বিক্রি করা সম্ভব। দিঘলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ কিশোর আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, পলিনেট হাউজটি এলাকায় ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছে। এই পদ্ধতি দেখতে ও জানতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে। উচ্চমূল্যের শাকসবজি উৎপাদনে এটি রোল মডেল হিসেবে তৈরি করতে চাচ্ছি। এ থেকে সারা বছর নিরাপদ ও রোগমুক্ত ফসল পাওয়া যাবে, যা বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এটি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। এদিকে লাখোহাটি এলাকার নূর ইসলাম শেখের পলিনেট হাউজের প্রকল্পটি পরিদর্শনে আসেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালকবৃন্দ। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। কৃষিতেও এর প্রভাব পড়ায় আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আর এরই অংশ পলিনেট হাউজ। এর জন্য আমরা কৃষকদের বিনাখরচে নেট হাউজ নির্মাণ করে দিয়েছি। উপরে যে পদ্ধতিতে ছাউনির ব্যবস্থা করা তার জন্য সূর্যের আলো ৫০ ভাগ কম পড়বে ক্ষেতে। এছাড়াও চারপাশে পলিনেট দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে, যাতে কোনো পোকা-মাকড় ক্ষেতে প্রবেশ করতে না পারে। এখানে কোনো কীটনাশক দিতে হবে না। বাইরে যে ফসল করা সম্ভব হবে না, তা পলিনেট হাউজে সারা বছর চাষ করা যাবে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, এখানে নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করা। তিনি বলেন, এই আধুনিক পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষ আরও সম্প্রসারিত হলে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষ বিষমুক্ত শাকসবজি খেতে পারবেন, অন্যদিকে কৃষকও এ থেকে ব্যাপক লাভবান হতে পারবেন।

Share this post

PinIt
scroll to top