খুলনার দিঘলিয়ায় খাল খননের নামে বন্য গাছ কাটার ঘটনায় বিক্ষোভ

19.jpg

শেখ শামীমুল ইসলাম, দিঘলিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, মানুষের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী বৃক্ষ রোপনের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ঠিক তখনই খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাইকিং করে স্থানীয় নাককাটি নামক একটি খালের উভয় পাড়ের জীবন্ত গাছ কেটে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছেন।
ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীবন্ত বৃক্ষ নিধন রোধে পরিবেশবাদী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খান মাসুম বিল্লাহ বলেন, বিষয়টি অবগত হওয়ার পরই গাছ কাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, খাল খননের নামে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ঘটনায় সরেজমিনে তদন্তে এসে এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েন ঠিকাদার ও প্রকল্পের উপ-পরিচালক। সোমবার সাড়ে ১১ টায় গাছ কাটা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সাসটেইনেবল পোস্টাল
এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রি ও ঠিকাদার মোহাম্মদ আরিফ রহমান। এ সময় এলাকাবাসী ক্ষতি পূরনের দাবিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণের দাবিতে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে রোববার রাতে দিঘলিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন ইবনুল হাসান মিনার।
সরেজমিনে গিয়ে এলাকাবাসী ও মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, মৎস্য অফিসের তত্ত্বাবধায়নে ‘শরীফ এন্ড ফিলামেন্ট’ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার ব্রহ্মগাতি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নাককাটি খালটি খননের জন্য কার্যাদেশ
পেয়েছেন। যেখানে ৪ এপ্রিল থেকে ১০ অক্টোবরের মধ্যে কাজ সমাপ্তির মেয়াদ রয়েছে। খালের দৈর্ঘ্য ৪.৪ কিলোমিটার। ৫৬ লাখ ৬৫ হাজার ৯৬৮ টাকার
কার্যাদেশ পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরুর পূর্বে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনজুরুল ইসলামের মাধ্যমে এলাকায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচার করে নাককাটি খালের উভয়পাড়ের ব্যক্তি মালিকানা জমির বিভিন্ন প্রজাতির জীবন্ত গাছ , ঘরবাড়ি ও মৎস্য ঘের সরিয়ে ফেলার জন্য। তিন দিনের সময় সীমা বেধে দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ নির্দেশনা প্রদান করায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসকেভেটর বা ভেকু মেশিন চালিয়ে ইতিমধ্যে স্থানীয়দের বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৫ হাজার জীবন্ত গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মৎস্য ঘেরের ভেড়িবার ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ কাজে স্থানীয়রা বাঁধা দিলে তাদেরকে ভয়-ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা নওয়াব আলী জানান, মৎস্য অফিসের মাইকিং এর ফলে ভেকু চালকেরা জোরপূর্বক ভাবে আমাদের গাছগুলি উপড়ে ফেলে দিচ্ছে। তিনি জানান, তার বিভিন্ন প্রজাতির ১শ’ গাছ ইতিমধ্যে উপড়ে ফেলেছে।
আরেক বাসিন্দা সাবর আলী জানান, তার ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থেকে ঘরবাড়ি ভেঙে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ঠিকাদারের লোক ও ভেকু চালক চাপ দিচ্ছেন। অন্যথায় আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন।
কামাল হোসেন, নিতাই দাস, হামিদ শেখসহ স্থানীয়দের অভিযোগ, মৎস্য কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলামের মাইকিং এর ফলে স্থানীয়দের মধ্যে একটি আতঙ্ক তৈরি হয়। এ সুযোগে ঠিকাদারের লোক ও ভেকু চালক জোর করে খালের উভয়পাড় থেকে জীবন্ত গাছগুলি উপড়ে ফেলে দিচ্ছে।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা ইবনুল হাসান মিনার জানান, তার মালিকানা জায়গার পাশ্ববর্তী মালিকের জায়গা থেকে জোর করে ভেকু চালক জীবন্ত গাছ উপড়ে ফেলেছে। তার জায়গা থেকে গাছ কাটতে বা উপড়ে ফেলে দিতে বাঁধা দিলে তারা সরকারি কাজে বাঁধা প্রদানের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদান করেছে। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছি।
এলাকাবাসী জানান, খাল খননের নামে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলামের মাইকিং এর ফলে ইতিমধ্যে নাককাঠি খালের উভয় পাড় থেকে বিভিন্ন প্রজাতির জীবন্ত প্রায়(ছোট-বড়) ৫ হাজার কাজ কর্তন করা হয়েছে ।
দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে উভয় পাড় থেকে ১৮ থেকে ২০ হাজার জীবন্ত বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কর্তন করে ফেলা হবে এর ফলে স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সামাজিক সংগঠনগুলো। ভুক্তভোগীদের দাবি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিবেশের বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম মাইকিং এ প্রচারের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, খালের উভয় পার্ট থেকে গাছগুলি সরিয়ে ফেলার অনুরোধ জানিয়েছি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার খান মাসুম বিল্লাহ বলেন, পরিবেশবান্ধব গাছ কোনভাবেই কর্তন করা যাবে না। খাল খনন করতে খালের দুই পাড়ের গাছ কোনভাবেই কাটা ও ঘর বাড়ি ভাঙ্গা যাবে না ।
তিনি আরো বলেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাইকিং এর মাধ্যমে জীবন্ত গাছ কেটে ফেলার নির্দেশনা দিতে পারেন না। তিনি মাইকিং এর প্রচারের মাধ্যমে কেন গাছ কাটার নির্দেশনা দিয়েছেন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রোপ্রাইটার আরিফুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের গাছ কাটার কোন নির্দেশনা নেই, আমরা কাটতেও পারিনা। গাছ না কেটে যদি খাল খনন করতে বলে তাও আমরা করবো। আমার কোন লোক ম্যানেজার ও ভেকু চালক এলাকাবাসীর উপর জোরপূর্বক গাছ কর্তন ও ঘর বাড়ি ভাঙ্গার হুমকি দিয়ে থাকলে তার শাস্তি হবে।
জোর করার কোন সুযোগ নেই। সাসটেইনেবল পোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রি এলাকাবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা এলাকাবাসীর কোন ক্ষতি করে কাজ করতে চাই না। কোন সুযোগও নেই গাছ কাটার। এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে যদি কোন কাজ করা যায় এটাই মঙ্গল।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলা মৎস্য মনজুরুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মারুফুল ইসলাম বলেন, ব্যাক্তি মালিকানাধীন গাছ ও ঘরবাড়ির ক্ষতি করে খাল খনন করা যাবে না। আর যে গাছ-পালার ক্ষতি হয়েছে- তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া লাগবে। বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসী ও ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

Share this post

PinIt
scroll to top