দেশের তথ্য ডেস্ক।।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে রিমাল গত রবিবার বিকেল ৪টার দিকে বাংলাদেশের স্থলভাগ স্পর্শ করে। গতকাল সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত এটি বাংলাদেশের স্থলভাগে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ছিল।
আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় ১৭ ঘণ্টায় এটি বাংলাদেশের স্থলভাগ অতিক্রম করে, যা কিছুটা অস্বাভাবিক। এতে ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটি বড় কারণ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল সকাল ৯টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এটি স্থল গভীর নিম্নচাপ হিসেবে যশোর ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছিল। গত রাত ৮টায় এটি আরো কিছুটা দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপ হিসেবে মানিকগঞ্জে অবস্থান করছিল।
এর প্রভাবে গত রবিবার বিকেলের পর থেকে দেশজুড়ে বৃষ্টি হচ্ছে।
মূলত ধীরগতিসম্পন্ন হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের কাছে এসেও শক্তি সঞ্চয় করে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে, যা বাংলাদেশের উপকূল থেকে ৯০০ কিলোমিটারের মধ্যে। অর্থাৎ এটি উপকূল থেকে মোটামুটি কাছেই সৃষ্টি হয়েছে।
মূলত গতি ধীর হওয়ার কারণে এটি স্বল্প দূরত্বে থেকেও সাগরে বেশি সময় পেয়ে বেশি শক্তি অর্জন করেছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের সাধারণ গতিবেগ ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার। ৩০ কিলোমিটার হলে সেটাকে উচ্চ গতিসম্পন্ন বলা হয়। ১৫ কিলোমিটারের নিচে নামলে তা ধীর গতিসম্পন্ন ধরা হয়। রিমাল গড়ে ১২ কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছে।
এর সর্বোচ্চ গতি ১৭ বা ১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠেছে। স্থলভাগে উঠেও এটি একই রকম আচরণ করেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পর রিমাল গত শনিবার রাত থেকে গত রবিবার সকাল পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছে। পরের তিন ঘণ্টা এর গতি ছিল সাত কিলোমিটার। দুপুরে এর গতি কিছু বেড়ে ১৩ কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছে। স্থলভাগে উঠেও এটি একই রকম ধীরগতিতে এগিয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সাধারণত ছয় থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে স্থলভাগ অতিক্রম করে গুরুত্বহীন হয়ে যায়। তবে রিমাল প্রায় ১৭ ঘণ্টা ধরে বাংলাদেশের স্থলভাগ অতিক্রম করে। অর্থাৎ এটি স্বাভাবিকের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি সময় ধরে স্থলভাগ অতিক্রম করেছে।
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘এটা অবশ্যই কিছুটা অস্বাভাবিক। পুরো ঘূর্ণিঝড়টির বিস্তৃতি (ব্যাস) ছিল প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। এটা অতিক্রম করতে এত সময় লাগার কথা নয়। গতি যদি ২৫ কিলোমিটার হতো রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যেই অতিক্রম সম্পন্ন করত। আমাদের আগের ঘূর্ণিঝড়গুলো সাধারণত এ রকম সময় নিয়েই স্থলভাগ অতিক্রম করেছে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় আইলাও কিছুটা এ রকম লম্বা সময় ধরে অবস্থান করেছিল বাংলাদেশের ওপর।’
আজিজুর রহমান বলেন, ‘এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন কিছুটা দায়ী। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সময়টায় আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা উত্তর বঙ্গোপসাগরের একদম কিনারে এসে ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি পেয়েছি। এর পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দায়ী। এ ধরনের তাপমাত্রা সাধারণত গভীর সমুদ্রে থাকে। উপকূলের এত কাছে এ রকম তাপমাত্রা থাকা এবং সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি অর্জন করাটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। সাধারণত ২৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা পার হলেই ঘূর্ণিঝড় তৈরির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, দ্রুত আঘাতের কারণ ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টিই হয়েছে উপকূলের কাছে। অন্য ঘূর্ণিঝড়গুলোর ক্ষেত্রে ছয় থেকে সাত দিন সময় পাওয়া যায়। এই ক্ষেত্রে লঘুচাপ তৈরি হওয়া থেকে শুরু করে আঘাত হানা পর্যন্ত মাত্র চার দিন সময় পাওয়া গেছে। এটিও আরেকটি ব্যতিক্রম। সব কিছু মিলিয়ে এই ঘূর্ণিঝড়টি কিছুটা ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে।
এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের (আইডাব্লিউএফএম) অধ্যাপক এ কে সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখছি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় হয়ে আবার স্থলভাগে আঘাত করছে। আবার অনেক লম্বা সময় নিয়ে স্থলভাগ অতিক্রম করেছে।’
অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে আগেও ঘূর্ণিঝড় হতো। কিন্তু সব বাংলাদেশের দিকে আসত না। কিন্তু এখন প্রতিবছরই বাংলাদেশের দিকে আসছে। এর প্রধান কারণ বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। এ বছর অনেক বেশি তাপপ্রবাহ ছিল। সমুদ্রে এখন প্রায় ৩১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। এখন এমন হয়ে গেছে যে ঘূর্ণিঝড় প্রতিবছর এমনকি প্রতি মৌসুমেও হতে পারে। এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘এটা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রস্তুতি, দ্রুত পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরো সজাগ হতে হবে।’
জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটার হার ও তীব্রতা দুটোই ভবিষ্যতে বাড়বে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও সমুদ্রে পানির তাপমাত্রা বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। বিষয়টি মাথায় রেখে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস পদ্ধতি ও সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতির বিষয়ে আরো সজাগ হতে হবে।’