দেশের তথ্য ডেস্ক।।
বিদেশ ভ্রমণ করাই যেন তাঁর নেশা। ২০১৭ সালের পর গত সাত বছরে বিশ্বের ৯টি দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গী করে গেছেন পাঁচটি দেশে। সরকারি পঞ্চম গ্রেডের একজন কর্মকর্তার নিজ খরচে এই বিদেশভ্রমণের অর্থের উৎস নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
দুর্নীতির মাধ্যমে বহির্গমন ছাড়পত্র (স্মার্ট কার্ড) দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগের অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তাঁকে। তিনি হলেন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট (এসএ) মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৩ সালের ৩ জুন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর আওতাধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলের অধীন সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে ৬০ হাজার টাকা বেতনে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ।
এরপর তিনি জড়িয়ে পড়েন বহির্গমন ছাড়পত্রের (স্মার্ট কার্ড) অবৈধ বাণিজ্যে। জাল ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন বড় অঙ্কের টাকা। এই টাকায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন দেশ। কখনো কখনো নেন না সরকারি অনুমতি।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩ অনুযায়ী জাল ক্লিয়ারেন্স ব্যবহার করে বিদেশে লোক পাঠানো মানবপাচারের শামিল। ২০১৩ সালের ৩ জুন নিয়োগের পর বিদেশগামী কর্মীদের সার্ভার ও স্মার্ট কার্ড প্রদানসংক্রান্ত দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন মামুন অর রশিদ। এর আগে সার্ভার জালিয়াতি ও ভুয়া স্মার্ট কার্ড দেওয়ার জন্য একাধিকবার তাঁর নাম এসেছে। নথি অনুমোদন এবং সার্ভারে এন্ট্রি ব্যতীত দুর্নীতির মাধ্যমে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকেন তিনি।
এদিকে ২০২২ সালের ৭ জুলাই দুদকের উপপরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, নথি অনুমোদন এবং সার্ভারে এন্ট্রি ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে বহির্গমন ছাড়পত্র দেওয়ার অভিযোগে ডাটাবেইস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মো. সাইদুল ইসলাম, সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. মামুন অর রশিদ, হার্ডওয়্যার টেকনিশিয়ান মো. মাসুদ পারভেজ এবং মেইনটেন্যান্স টেকনিশিয়ান শফিউজ্জামান বিপ্লবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০২২ সালের ১৭ জুলাই উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অনুমতি নিয়ে মামুন অর রশিদ সৌদি আরব, আমেরিকা, লন্ডন, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, গ্রিসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এর মধ্যে স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা এবং ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ঘুরেছেন পাঁচটি দেশ। সর্বশেষ ওমরাহ পালনে সৌদি আরবে গেলেও তিনি অফিস থেকে বিদেশ গমনের জন্য ছুটি বা সরকারের অনুমতি নেননি, যা সরকারি নিয়োগবিধি পরিপন্থী।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে চলতি বছরের ২৯ মার্চ রাত ২টায় ডাব্লিউওয়াই ৩১৮ ফ্লাইটে ওমরাহর জন্য সৌদি আরবের মদিনার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন মামুন। পরে ৮ এপ্রিল রাত ২টা ৫১ মিনিটে ডাব্লিউওয়াই ৩১৭ ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন। একই পাসপোর্ট ব্যবহার করে ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ৬ মিনিটে ভিজিট ভিসায় কাতার এয়ারলাইনসের কিউআর ৬৩৯ ফ্লাইটে আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমেরিকার নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। পরে ৬ অক্টোবর সকাল ৭টা ২৭ মিনিটে কিউআর ৬৩৪ ফ্লাইটযোগে ঢাকায় ফেরেন।
এ ছাড়া মামুন ২০২২ সালের ১৫ জুন সকাল ৯টা ৪৪ মিনিটে ভিজিট ভিসায় এমিরেটস এয়ারলাইনসের ইকে ৫৮৫ ফ্লাইটযোগে লন্ডনের উদ্দেশে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ৬ জুলাই রাত ১২টা ১৮ মিনিটে একই এয়ারলাইনসের ইকে ৫৮৪ ফ্লাইটযোগে দুবাই হয়ে ঢাকায় অবতরণ করেন। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর টার্কিশ এয়ারলাইনসে করে ভিজিট ভিসায় অস্ট্রিয়ায় যান।
একই বছরের ১৯ জুলাই ভিজিট ভিসায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে এমএইচ ১৯৭ ফ্লাইটযোগে ১১টা ৫৭ মিনিটে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন এবং ২৭ জুলাই ড্রাগন এয়ারলাইনসের কেএ ১১০ ফ্লাইটে হংকং হয়ে দেশে ফেরেন। তিনি ২০১৯ সালের ২২ মার্চ ভিজিট ভিসায় কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন এবং ২৬ মার্চ একই এয়ারলাইনসের বিএস ২১৪ ফ্লাইটযোগে ব্যাঙ্কক হয়ে দেশে ফেরেন।
এদিকে মামুন ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ভিজিট ভিসায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিজি ০০৮৮ ফ্লাইটযোগে ব্যাঙ্ককের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন এবং ১৯ ডিসেম্বর একই এয়ারলাইনসের বিজি ০৮৭ ফ্লাইটযোগে কুয়ালালামপুর হয়ে দেশে ফেরেন। ২০১৮ সালের ৫ জুলাই ব্যাঙ্কক ও ২০১৭ সালের ১৩ জুন গ্রিসের এথেন্স ভ্রমণে যান তিনি।
অনুমতি না নিয়ে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ বলেন, ‘আমাদের জিও (সরকারি অনুমতি) নিয়ে যে বিদেশ যেতে হয়, এটা আপনাকে কে শিখিয়েছে? কোথা থেকে জেনেছেন? আর আমি জিও নিয়ে বিদেশ যাই নাই। আপনার সমস্যা কী? আপনে কী করবেন, পারলে করেন।’
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য-প্রযুক্তি, গবেষণা ও পরিকল্পনা পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘উনি (মামুন) ছুটি নিয়েছেন কি না, তা আমার জানা নেই। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, তাই অবশ্যই খোঁজ নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান বলেন, ‘অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশভ্রমণের সুযোগ নেই। যদি অনুমতি ছাড়া কেউ বিদেশভ্রমণ করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে অভিযোগ পেলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সরকারের নীতির বাইরে চললেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’