দেশের তথ্য ডেস্ক।।
আজ ১৩ মে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফা ভোটগ্রহণ। চতুর্থ দফার পরও আরো তিন দফা ভোটগ্রহণ চলবে। ভোট পর্ব শেষ হবে ১ জুন। আর ভোটের বাক্স থেকে ফল বের হবে ৪ জুন।
যত দিন ভোট পর্ব চলছে, ক্রমে বিজেপির পাশাপাশি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠছেন নরেন্দ্র মোদি। সবারই প্রশ্ন, এবার নরেন্দ্র মোদির বিজেপি কি সত্যি সত্যি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে? নাকি ভোটের ফলে কোনো অপ্রত্যাশিত ধাক্কা আসতে পারে? নরেন্দ্র মোদি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন না—এ কথা এখনো কেউই বলছে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন—আব কি বার, ৪০০ পার। সেটা যতটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের জন্য বলেছিলেন, বাস্তবে পরিস্থিতি তা নয়—এমনটা অনেকে বলতে শুরু করেছে।
আর এসবের মধ্যে স্টক মার্কেটের বিপুল ধস নামা এবং শিল্পপতিদের ভূমিকা নিয়ে কটাক্ষ—এসব বিষয় অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। সম্প্রতি দেশের বাইরে গিয়েছিলাম কয়েক দিনের জন্য। সেখানেও সেই একই আলোচনা। চার দিনের জন্য মাসকাট গিয়েছিলাম।
জাতিসংঘের উৎসাহে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক আলোচনাসভায় যোগ দিতে। বিষয় : প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি। শুধু ভারতীয় নয়, সেখানে নানা দেশের মানুষ। মজার ব্যাপার হলো, কূটনীতির আলোচনার মধ্যে মাঝে মাঝেই নানাভাবে এসে পড়ছিল ভারতের এবারের নির্বাচন প্রসঙ্গ। কী হবে নরেন্দ্র মোদির? আচ্ছা তিনিই কি আবার ক্ষমতাসীন হবেন? কিন্তু কেন এমন প্রচার? যত দিন যাচ্ছে, এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে যে বিজেপির সমর্থক সংখ্যা নাকি ক্রমেই কমছে! তিন দফা ভোটের পর গরিষ্ঠতার গ্যারান্টি কেন উধাও? শেয়ার মার্কেটে এমন ধস নামছে কেন? মোদির ফেরা নিয়ে কি শিল্পপতিরাও ধন্দে?
লন্ডন থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা তো প্রতিনিধিদলে একমাত্র বাঙালিকে পেয়ে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে দিলেন।
২০১৯ সালে বিজেপি পেয়েছিল ১৮। তাহলে এবার কি বিজেপির আসন পশ্চিমবঙ্গে বাড়বে, না কমবে?
বুঝতে পারছিলাম, ওই আলোচনায় যোগ দেওয়া বহু মানুষই মোদিভক্ত। বিশ্বগুরুর ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কেন এত প্রশ্ন, জানেন? কারণ একটাই। ভারতের হিন্দি বলয়ে বা যেসব এলাকায় বিজেপির শক্তিশালী ভোট ব্যাংক আছে, সেসব ভোটকেন্দ্রে যদি গত ১০ বছরে সামান্যতম অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি হয়, তাহলে তো সংখ্যা কমতে বাধ্য। সে তো ল অব নেচার। দিল্লিতে লোকসভা কেন্দ্র সাতটি। ‘মোদি ফ্যাক্টর’ যতই শক্তিশালী হোক, সাতের জায়গায় বিজেপির আটটি আসন তো লাভ হতে পারে না। তাই দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের মতো নন-বেস এরিয়ায় বিজেপির আসন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। আর এসব এলাকার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির কাছে প্রথম থেকেই তো অগ্রাধিকার।
২০১৯ সালে ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন পেয়ে বিজেপির ক্ষুধা তো আরো বেড়ে গেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আবার ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু বিজেপি রণে ভঙ্গ দেয়নি। শতকরা ভোট ব্যাংক আছে, অনেকটা তাই বিজেপির ২০২৪ সালে বিশেষ আশা ছিল। বিশেষত উত্তরবঙ্গে। তা ছাড়া বিজেপি প্রথম থেকেই ভেবেছে, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট মানে মোদির ভোট, অতএব মোদির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এখনো অনেক। জাতীয় স্তরে কোনো বিকল্পও নেই। তাই বিজেপি মনে করেছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবার আরো আসন আসবে। অমিত শাহ তো প্রথমে দলীয় বৈঠকে বাংলায় ৩০ থেকে ৩৫টি আসন পাওয়ার কথা বলেছিলেন। তবে সেটি যুদ্ধের সময় একজন জেনারেলের প্রত্যাশা তৈরির বিবৃতি, যাতে দলীয় কর্মীদের মনোবল বেড়ে যায়।
সমুদ্রতীরে জনমানবহীন ওমান দেশে বসে সবাইকে বলেছি, এখনো পশ্চিমবঙ্গে চার কিস্তিতে ভোট বাকি। ভোটের রাজনীতিও কোনো স্থিতিশীল ধারণা নয়, তা গতিশীল। সতত পরিবর্তনশীল। তবু বাংলায় এত দিন থাকলাম—ভোটের সময়, শিকড় ও বাংলার হাওয়ায় বাংলার ভালো-মন্দর নাড়ির সঙ্গে আজীবন যুক্ত। বাংলার ভবিষ্যৎ, বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই কোনো আলোচনা করছি না। সেটি একটি পৃথক বিষয়। কিন্তু ভোটের রাজনীতির বিষয়ে বলতে পারি, বিজেপির পক্ষে এবার ১৮টি আসন ধরে রাখাই কঠিন। আসনসংখ্যা আঠারোর তলায় চলে গেলেও বিস্মিত হব না।
জ্যোতিষী নই, পোলস্টারও নই। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে বলতে পারি, এ রাজ্যে বিজেপির রামমন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা কোনো বড় আবেগতাড়িত ইস্যু হয়নি। দ্বিতীয়ত, নাগরিকত্ব বিল হিন্দি বলয়ে কী প্রতিক্রিয়া হবে, জানি না। কিন্তু বাংলায় বিজেপির জন্য উল্টো হয়ে গেল। শতকরা ৩০ ভাগ মুসলমান আরো বেশি করে তৃণমূলের ছাতার তলায় এসেছে। মুসলিম ভোট ভাঙার সম্ভাবনা এবার খুবই কম। এ জন্য ২০১৯, এমনকি ২০২১ সালেও ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ যতটা প্রাসঙ্গিক ছিল, এবার তা নয়। এবার তো আইএসএফের সঙ্গে সিপিএম নির্বাচনী জোট পর্যন্ত করেনি। তৃতীয়ত, উত্তরবঙ্গে বিজেপি পৃথক রাজ্যর দাবিতে সোচ্চার হয়নি। দক্ষিণবঙ্গের ভোট হারানোর ভয়ে, ফলে উত্তরবঙ্গে তৃণমূল গতবারের তুলনায় এবার ভালো ফল করছে। বিজেপি এমতাবস্থায় সন্দেশখালী ইস্যুকেও প্রধান প্রচারের বিষয় করে। কিন্তু তৃণমূলের আক্রমণাত্মক পাল্টা রণকৌশল বিজেপির কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। সন্দেশখালীর স্টিং অপারেশনে স্পষ্ট হয়ে গেছে বিজেপি কিভাবে সন্দেশখালীতে গণধর্ষণের ‘প্লট’ তৈরি করেছিল। তৃণমূলের এই আক্রমণাত্মক রণকৌশলের প্রধান কারিগর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
নরেন্দ্র মোদি অবশ্য দুর্নীতিকেই প্রধান হাতিয়ার করতে চাইছেন। শিল্পক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি বা রাজ্যের মন্ত্রীদের দুর্নীতিকেই প্রধান ইস্যু করতে চাইছেন। তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে বাঙালির মধ্যবিত্ত সমাজে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই এমনও নয়, কিন্তু সিবিআই, ইডি, আয়কর বিভাগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ কাজ করছে, বিজেপির খাতায় নাম লেখালে সব দোষ মাফ, এই ‘ওয়াশিং মেশিন’ তত্ত্ব ও পাল্টা প্রভাব জনমানসে নেই, তা নয়।
আরো একটি ব্যাপার। দিল্লির বিজেপি নেতারা এখন বলছেন যে মোদির ব্র্যান্ড ইকুইটি এখনো শক্তিশালী, কিন্তু উত্তর প্রদেশে তাঁর বার্তা গ্রামে-গ্রামে ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যেমন যোগী আদিত্যনাথ আছেন, তেমনটি বাংলায় নেই। শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ পরিশ্রম কম করছেন না, কিন্তু এখনো জাতীয় স্তরে যেমন মোদির বিকল্প মুখ নেই, তেমনি রাজ্যেও নেই মমতার বিকল্প মুখ।