দেশের তথ্য ডেস্ক।।
পূর্ব সুন্দরবনে আগুন লাগার প্রেক্ষাপটে আবারও নদী খননের কথাটি জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এ কথা দেশবাসী তথা বিশ্ববাসী জেনে গেছে যে বিশ্ব ঐতিহ্য, জলাভূমি, বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনের পূর্বাংশে আবারও আগুন লেগেছে। বনে আগুন লাগে, দাবানলের সৃষ্টি হয়; তাই বলে নোনা জলাভূমির বনে আগুন? ঘটনাটি বেশ খটকা লাগে। কারণ খুবই পরিষ্কার; জলাভূমি মানে তো পানি, ভেজা, কর্দমাক্ত এলাকা—এটাই যখন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, তখন সেখানে কিভাবে আগুন লাগে? আগুন লাগছে।
একবার, দুইবার নয়, অনেকবার। ১৯৭০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪০ বার আগুন লেগেছে পূর্ব সুন্দরবনে। ১৯৭০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আগুন লেগেছে ১৫ বার। এরপর ২০০২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৫ বার।
এর সহজ সরল অর্থ হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগুন ঘন ঘন লাগছে। বছরে তিনবারও আগুন লাগার ঘটনা আছে।
প্রশ্নটি হচ্ছে, নোনা জলাভূমির বনে আগুন কেন লাগছে? কারণ ওই এলাকাটি শুষ্ক। স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টির পানি ছাড়া ওই এলাকার মাটি ভেজে না; স্বাভাবিকভাবে গাছপালাও ভেজে না।
আবার ওই এলাকাটিতে ঝোপজাতীয় লতা-গুল্মের উপস্থিতি অনেক বেশি। শুষ্ক জায়গাটিতে বসন্তে গাছপালা থেকে পাতা ঝরে নতুন পাতা গজায়। এই ঝরা পাতার স্তূপ জমে মাটিতে। ঝরা পাতা ও লতা-গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ শুষ্ক মৌসুমে হয়ে ওঠে একেবারে শুকনা কড়কড়ে। যে বছর প্রকৃতি বেশি রুক্ষ হয়, তাপমাত্রা ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েক দিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার কমবেশি থাকে, তখন এলাকাটি মুড়ি ভাজার খোলার (মাটির পাত্র) মতো তেতে থাকে।
ফলে কোনোভাবে আগুনের ফুলকির সংস্পর্শ পেলে তাতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। এই আগুন মাটিসংলগ্ন বা মাটির সামান্য নিচ দিয়ে অর্থাৎ গাছের শিকড়ের সাহায্যে ভূমিতে বিস্তৃত হয়। এরও কারণ, শুকিয়ে যাওয়া ভূমিতে লতাজাতীয় গাছের কারণে শুকনা মাটি দিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা।
এই অবস্থাটি কি সুন্দরবনে দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বা আগুন লাগার পরবর্তীকালে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানেন না বা বোঝেন না? তাঁরা জানেন এবং বোঝেনও। এ কারণে তদন্ত কমিটির অন্যতম একটি প্রধান সুপারিশ হচ্ছে, মরা ভোলা (ভোলা নদীর একটি অংশ, যা অনেক আগেই শুকিয়ে যাওয়ায় ওই অংশটিকে মরা ভোলা বলা হয়) এবং ভোলা নদী খনন করতে হবে; ওই এলাকায় পুকুর খনন করতে হবে। এর কারণ হচ্ছে, এলাকাটি ভেজা বা নরম রাখতে হবে। কিন্তু অদ্যাবধি এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ভোলা নদী খনন করা হয়েছিল। ১০০ হাতেরও বেশি প্রশস্তের ভোলা নদী খনন করে তা এখন একটি ১০ থেকে ২০ হাত প্রস্থের খালে পরিণত করা হয়েছে। এতে জোয়ারের সময়ও শুষ্ক মৌসূমে খুব একটা পানি আসে না। আর সবচেয়ে বিপত্তি সৃষ্টিকারী যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা হচ্ছে নদী খনন করা মাটি নদীর পারে অর্থাৎ বনের প্রান্তেই জমা করা হয়েছে। এতে বিশাল এলাকাজুড়ে বনের পার উঁচু হয়ে বাঁধসদৃশ চেহারা নিয়েছে, তাতে অতি জোয়ারের পানিও বনে প্রবেশ করতে পারে না। আর স্বাভাবিকভাবে মরা ভোলা শুকিয়ে যাওয়ায় এর সঙ্গে সংযুক্ত বন অভ্যন্তরের খালগুলোও শুকিয়ে একাকার হয়ে গেছে।
সর্বশেষ পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়ায় ৪ মে আগুন লাগার ঘটনায় আবারও এই নদী খননের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বন কর্মকর্তারা বলেছেন, এবারে নদী খনন করা হবে এবং এই কাজটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আমরা ধরে নিতে পারি, নদী খনন করা হবে। যদি নদী ও বনের অভ্যন্তরের খালগুলো খনন করা হয়, তাহলে এর মাটি কোথায় ফেলা বা জমা করা হবে? আমরা যদি নদী খননের স্বাভাবিক নিয়মে নদীর পারে অর্থাৎ বনের প্রান্তে মাটি জমা করি, তবে তা উঁচু ঢিবির মতো হবে এবং লম্বালম্বিভাবে ওই উঁচু ঢিবি বাঁধের চেহারা নিয়ে বনকে নদী বা খাল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, যা পূর্ব সুন্দরবনে ঘটেছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, মোংলা বন্দরের প্রধান চ্যানেল পশুর নদের নাব্যতা বজায় রাখার জন্য যে খনন প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল (প্রকল্পটি এখন স্থগিত আছে), সেই খননের মাটি রাখার জন্য পশ্চিম পারের বানিশান্তার কৃষিজমিকে নির্বাচন করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে বানিশান্তার কৃষিজীবী মানুষ তাদের তিন ফসলি জমি পশুর নদের মাটি রাখার জন্য দেয়নি। এটি স্বাভাবিকও। কারণ কৃষকের তিন ফসলি জমি মাটি ফেলে ভরাট করে দিলে তার ফসল ফলবে না, তার আয় হবে না। বলা হচ্ছিল, ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, তবে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল এবং জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়ে উৎপাদনক্ষমতা হারানোর শঙ্কা ছিল। মানুষ তাই বিরোধিতা করেছে। সুন্দরবনের পারে বা ভেতরে মাটি জমা করা খুবই সহজ। কারণ সুন্দরবন তো কথা বলতে পারে না, প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই যদি স্বাভাবিক নিয়মে নদী বা খাল খনন করে সেই মাটি বনের মধ্যে ফেলা বা জমা করা হয়, তবে ওই বনভূমির ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পাল্টে যাবে। যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি। জলাভূমি যদি শুষ্কভূমিতে রূপান্তরিত হয়, তবে আগুনে দগ্ধ হওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে। আগুন লাগলে আমরা নিভিয়ে ফেললাম আর আগুন লাগার জন্য দায়ীদের খুঁজে পেলে শাস্তি দিলাম। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে আগুন লাগার পরিবেশ যাতে তৈরি না হয়, তা নিরসন করা। দুনিয়াব্যাপী উচ্চারিত প্রধান সত্যটি হচ্ছে দুর্ঘটনার পর সেই ক্ষততে প্রলেপ দেওয়ার চেয়ে দুর্ঘটনার কারণগুলো কমিয়ে আনা।
আমরা জানি, সুুন্দরবনের সীমানা হচ্ছে নদী, সাগর। সুন্দরবনের পূর্ব-উত্তরের জিউধরা ফরেস্ট অফিস ও এর পূর্ব-পশ্চিম দিকে যেখানে মরা ভোলা নদীর অস্তিত্ব নেই; জনবসতি এবং বন একাকার, সেখানে মানুষের অবাধ যাতায়াত। রাখালরাও ওই সব এলাকায় গবাদি পশু চরাতে যায়। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা (নদী) না থাকায় সাপ ও অন্যান্য প্রাণী বনসংলগ্ন লোকালয়ে চলে আসে। গত বছর বেশ কয়েকটি পাইথন লোকালয়ে এসেছিল, যা আবার পরে বনে অবমুক্ত করা হয়। নদী টিকিয়ে রাখাটা অতি জরুরি। অবশ্য সুন্দরবনের নদীর ক্ষেত্রে আরো একটি সত্য হচ্ছে এই নদীগুলো জোয়ারের নদী; জোয়ারে বিপুল পরিমাণ পলি আসে, বাধা পেলেই সেই পলি জমতে থাকে। এখন নদীগর্ভেই পলি জমা হচ্ছে, পশুর নদে পলি জমা হওয়ার কারণে এর গভীরতা কমছে। আমরা যেকোনো কাজ করে স্বল্প মেয়াদে উপকার হয়তো পেতে পারি, তবে প্রাকৃতিক এই বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করলেই প্রাকৃতিক অবস্থা ও অবস্থান এবং ধরনটি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। নদী খননে তাই মাটি কোথায় ফেলা হবে, তা অনেক বেশি ভাবনার বিষয় এবং জরুরিও বটে। নদী খনন করে মাটি সুন্দরবনে জমা করলে কিন্তু উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে।