দেশের তথ্য ডেস্ক।।
পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরো অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। দৃশ্যমান বড় অবকাঠামোর কাজ তেমন বাকি না থাকলেও ছোট ছোট অনেক কাজ বাকি। নিয়োগ দেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত জনবল। সংকেতব্যবস্থা (সিগন্যালিং) স্থাপনের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে মাঝের বেশির ভাগ স্টেশন বন্ধ রেখে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালাতে তোড়জোড় শুরু করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
এই মুহূর্তে প্রকল্পের অধীন ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করছে। কিন্তু পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রকল্পটি।
আবার এখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত স্থাপিত সংকেতব্যবস্থা কার্যকর করা যাচ্ছে না।
স্টেশন বন্ধ রেখে ভাঙ্গার পর যশোর পর্যন্ত ট্রেন চললে স্টেশনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ আরো ঝুঁকিতে পড়বে। যেহেতু সংকেতব্যবস্থা শতভাগ কার্যকর থাকবে না, তাই চলতি পথে রেললাইনে দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রকল্প সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়ের চাপে শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে। প্রকল্পের সময় আরো এক বছর বেড়েছে।
চলতি সময় থেকে চার মাস বেশি সময় পাওয়া গেলেই কাজগুলো গুছিয়ে শেষ করা সম্ভব হতো। আবার এখন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের পর পরিচালনার জন্য জনবল পাওয়া না যাওয়ায় পরিচালনায় বাধা তৈরি হবে। জনবলের অভাবে যতটুকু অংশের কাজ শেষ হয়েছে, ততটুকু রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না।
আর দুই মাস পরই প্রকল্পের বর্তমান মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালাতে চায় রেলপথ মন্ত্রণালয়।
কিন্তু প্রকল্পে জুনের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরুর প্রস্তুতি নেই। অন্তত অক্টোবর পর্যন্ত সময় চান প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেভাবেই হোক জুনের মধ্যে ট্রেন পুরোপুরি চালু করার কথা। (মাঝের) স্টেশন চালু করতে স্টেশন মাস্টার দরকার হবে। আমরা জনবল নিয়োগের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বড় কোনো সমস্যা তৈরি না হলে জুনে ট্রেন চালু হবে।’
ভাঙ্গা জংশনে আরো ৬ মাস সময় দরকার
পদ্মা নদীকে মাঝে রেখে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথকে ভাঙ্গা জংশন মোটাদাগে মাঝে ভাগ করেছে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা জংশন পর্যন্ত স্টেশন রয়েছে ১০টি। আবার ভাঙ্গার পর যশোর পর্যন্ত আরো ১০টি স্টেশন রয়েছে।
ভাঙ্গা প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা এখানে নতুন জংশন গড়ে উঠবে। তিনমুখী ট্রেন চলাচল করবে। সংকেতসহ সব ধরনের কাজ শেষ করতে ভাঙ্গা জংশন স্টেশনে আরো ছয় মাস সময় দরকার। এ ছাড়া জুনে ঢাকার গেণ্ডারিয়া স্টেশনেও সংকেতের কাজ বাকি থেকে যেতে পারে।
গত ১ মে পর্যন্ত পুরো প্রকল্পে প্রায় ৮০ শতাংশ সংকেতের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ কাজ আগামী দুই মাসের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংকেতের কাজ বাকি রেখে চালালে দুর্ঘটনার ঝুঁকি
পুরো প্রকল্পের কাজ তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে : ঢাকা-মাওয়া, মাওয়া-ভাঙ্গা ও ভাঙ্গা-যশোর। প্রকল্পের নথির তথ্য বলছে, গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম অংশে ৯৩ শতাংশ কাজ হয়েছে, শেষ অংশের কাজ করেছে ৯৩ শতাংশ। আর মাঝের অংশের কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি, ৯৮.৮৫ শতাংশ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯১ শতাংশ।
দুই অংশের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা এখন ট্রেন চলছে। বাকি অংশের ভাঙ্গা থেকে যশোর পথে বেশি কাজ বাকি আছে নতুন স্টেশন ভবনের সংকেত স্থাপনে। ভবন নির্মাণের কাজ গড়ে ১৫ শতাংশ বাকি।
প্রকল্পের অধীন ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হলেও বেশির ভাগ লুপ লাইনের কাজ বাকি। রেললাইন জোড়া দেওয়ার (ওয়েল্ডিং) কাজও কিছু জায়গায় বাকি রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরে পাথর ফেলা, স্টেশন ভবন এবং যোগাযোগ ও সংকেতের কাজ বাকি রয়েছে। ঠিকাদারদের কাজের সম্ভাব্য ত্রুটি শনাক্ত করতেও অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন।
সূত্র বলছে, কারিগরি কাজ বাকি থাকায় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প চালু হলেও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে অতিরিক্ত সময় দরকার। সে ক্ষেত্রে মাঝের সব স্টেশনে ট্রেন থামার সুযোগ থাকবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, রেলের নিরাপত্তার প্রধান শর্তই হচ্ছে সংকেত। সংকেতব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর না করে ট্রেন চালানো দায়িত্বহীনতার বড় পরিচয়। এতে নিঃসন্দেহে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বাড়বে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় চাইলে আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে আমাদের দিক থেকে কাজ শেষের আগে চালু করার বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হবে না।’
খণ্ড খণ্ড চালুতে সুফল মিলছে না
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন চলাচল করছে। তবে এই নতুন রেলপথে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালানো প্রকল্পের লক্ষ্য। যদিও এই রেলপথ ব্যবহার করে রাজবাড়ী থেকে ঢাকা পর্যন্ত কমিউটার ট্রেনের চলাচল শুরু হয়েছে।
রেলওয়ের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা দিয়ে যশোরের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক যুক্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে ভাঙ্গা থেকে পাচুরিয়া-রাজবাড়ী সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
এই পথের মোট ২০টি স্টেশনের মধ্যে ১৪টিই নতুন নির্মাণ করা হচ্ছে। আর বিদ্যমান ছয়টি স্টেশন সংস্কার করে আধুনিক করা হচ্ছে। এই স্টেশনগুলোর কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্তরে পাথর ফেলার কাজ শেষ হয়েছে ৮৮ শতাংশ। অবকাঠামোর অন্যান্য কাজ প্রায় পুরোপুরি শেষ।
পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, খণ্ডিতভাবে চালু হওয়ায় বেশি যাত্রী হচ্ছে না। কিন্তু রেল, কোচ, লোকোমোটিভ, জ্বালানির ক্ষয় যা হওয়ায় তাই হচ্ছে। বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কোনো উপযোগিতাই তৈরি হচ্ছে না।
প্রকল্পের ব্যয় কমছে ২৩৪ কোটি টাকা
প্রকল্পের মোট ব্যয় কমতে যাচ্ছে। খরচের বড় ১০টি খাতের মধ্যে ব্যয় বেড়েছে প্রায় এক হাজার ৮৪৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে বাকি পাঁচ খাতে ব্যয় কমেছে এর কিছু বেশি। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় কমছে প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা।
রেলের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি খরচ কমেছে ভূমি অধিগ্রহণে, এক হাজার ১৭২ কোটি ২৭ লাখ টাকা, যা মোট প্রকল্পের প্রায় ৩ শতাংশ। পুনর্বাসনে ব্যয় কমেছে ১১৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বিভিন্ন প্রকার সম্পদ ক্রয়ের ক্ষেত্রে খরচ বেঁচেছে ১২ কোটি ২০ লাখ টাকা। থোক বরাদ্দ কমেছে ৭৬৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
প্রকল্পের খরচ থেকে সরকারের শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করায় খরচ বেড়েছে ৫০৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। পাশাপাশি আমদানি শুল্কে খরচ বেড়েছে ১৭৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। পরামর্শক ব্যয় বেড়েছে ৩০৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ইউটিলিটি স্থানান্তরে খরচ বেড়েছে ১৫১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আবার বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়েছে ৭১৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।