দেশের তথ্য ডেস্ক।।
বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করায় বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুত ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় কিস্তির এই অর্থ ছাড় করা হতে পারে। মোট প্রতিশ্রুত ঋণের মধ্যে এর আগে দুই কিস্তিতে প্রায় ১০৬ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করেছে সংস্থাটি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে এই ঋণ নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশকে তৃতীয় কিস্তির ঋণের অর্থ দিতে সম্মত আইএমএফগতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে এসব কথা জানিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির প্রতিনিধিদল গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় আসে। গতকাল পর্যন্ত ১৫ দিনে প্রতিনিধিদলটি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেছে। সংস্থাটির তহবিল ব্যবস্থাপনার আওতায় আসা প্রতিনিধিদল ঢাকায় দ্বিতীয় পর্যালোচনা শেষ করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছেছে।
চুক্তিটি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড অনুমোদন করবে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বোর্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যালোচনা প্রতিবেদন বোর্ড অনুমোদন করলে এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) ও এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির (ইএফএফ) আওতায় প্রায় ৯৩২ মিলিয়ন ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় আরো প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার পাবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বোর্ডের অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ প্রায় ১১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার পাবে।
ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে আইএমএফ প্রতিনিধিদল ১৫ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে ঋণের তৃতীয় কিস্তি নিয়ে এসব তথ্য জানায়। তাদের সফরকালে অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলায় সংকটকালীন সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে বিনিময় হারের পুনর্বিন্যাস করতে ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার উদারীকরণ করেছে। এই সংস্কার কার্যক্রম সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গতি আনবে।
আইএমএফ সমর্থিত এই অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশ অনুকূল প্রবৃদ্ধি অর্জনকে ত্বরান্বিত করবে।
পাশাপাশি জলবায়ু কার্যক্রম বাংলাদেশকে একটি কঠিন বাহ্যিক পরিবেশেও সঠিক পথে চলতে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির আওতায় কাঠামোগত সংস্কারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যার মধ্যে পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য একটি সূত্রভিত্তিক জ্বালানিমূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক পরিস্থিতির কড়াকড়ি, আন্তর্জাতিক পণ্য ও খাদ্যের উচ্চমূল্য এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা মিলিয়ে ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপ বেড়েছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যায়ক্রমে কমে এসেছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়িয়েছে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জটিলতা বাড়িয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুনরুদ্ধার করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহসী পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে বাহ্যিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ক্রান্তিকালীন পদক্ষেপ হিসেবে বৃহত্তম বিনিময় হারে ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হারের উদারীকরণের পর এবং বিনিময় হার সংস্কারের ফলে যেকোনো মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে সহায়ক হবে। মুদ্রানীতির কড়াকড়ির সহায়ক হওয়া উচিত রাজস্বভিত্তিক আর্থিক নীতি। যদি বাহ্যিক ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ তীব্র হয়, তাহলে আরো কঠোর নীতি করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বলে মত দিয়েছে আইএমএফ।
এসব নীতি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন শুরু হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করছে সংস্থাটি। চলমান আমদানি সংকোচন এবং কঠোর নীতির কারণে চলতি অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৪ শতাংশ হতে পারে।
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম। সামাজিক সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার দেওয়া অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে জিডিপির ০.৫ শতাংশ করে কর রাজস্ব বাড়াতে বাস্তব কর নীতি ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সময়ে মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল, সহগামী বাস্তবায়ন কাঠামোসহ ভবিষ্যতের সংস্কারের পথ তৈরি করতে বলেছে আইএমএফ। এ ছাড়া ভর্তুকি কমানো, ব্যয় দক্ষতা উন্নত করা, আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক নিরাপত্তা আরো বাড়াতে হবে।
ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার রয়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোর কৌশল বাস্তবায়নের কথাও বলেছে আইএমএফ। পাশাপাশি করপোরেট গভর্ন্যান্স এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর উন্নতির আইনি সংস্কার অব্যাহত রাখতে বলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করতে বলেছে সংস্থাটি।
২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় পৌঁছতে সংস্কারের গতি অব্যাহত রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ, আরো বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, বিনিয়োগের পরিবেশ বাড়ানো এবং সুশাসন জোরদার করতে বলেছে সংস্থাটি।
বিবৃতিতে আইএমএফ আরো বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জোরদার পদক্ষেপে স্থীতিশীল পরিবেশ তৈরি হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক ঝুঁকি প্রশমিত হবে।
আইএমএফ বিবৃতি দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাজারভিত্তিক, টাকার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে নতুন পদ্ধতি চালু এবং নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এই বিষয়গুলো আইএমএফের শর্তে ছিল।
আইএমএফের ঋণ নিয়ে উদ্বেগ নেই : অর্থ প্রতিমন্ত্রী
আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়া নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। তিনি বলেন, আইএমএফ নতুন করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আয় বাড়ানো, সুদহারের বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিয়েছে। জলবায়ু ও দুর্যোগ মোকাবেলার পরামর্শ অনুসরণ করে চলতি বছরেই কাজ শুরু করবে সরকার।
গতকাল ঢাকায় সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান অর্থ প্রতিমন্ত্রী।
আইএমএফ প্রতিনিধিদল অর্থ প্রতিমন্ত্রীর কাছে ঋণের শর্ত ও সংস্কারের কতটা অগ্রগতি এবং আরো কতটা করতে হবে সেই সুপারিশের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরে। আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে এদিন কথা বলেন অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদারও।