দেশের তথ্য ডেস্ক।।
দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনে গত বছর থেকে ধাপে ধাপে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। আগামী বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি এই পরিবর্তনের ধারায় আসবে। নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বদলে যাবে চলমান পাঠদানব্যবস্থা।
এ জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ হাতে নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, যার বাস্তবায়নে নতুন শিক্ষাক্রমের উপযোগী পাঠদান পরিচালনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা যায়, গত বছর প্রাথমিকে প্রথম এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়। এ বছর চালু হয় দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। শুধু শিক্ষকদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ শিক্ষাক্রম চালুর চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও মূল্যায়ন করতে গিয়ে বড় ধরনের জটিলতায় পড়তে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দেয়।
সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যেসব জটিলতা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা নিয়ে বেশ আগেই কাজ শুরু করে এনসিটিবি। সম্প্রতি তারা একাধিক চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে সে ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে প্রস্তাব দিয়েছে।
সেগুলোর মধ্যে দুই শিফট তুলে দেওয়া, ভবিষ্যতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১ঃ৪০ এ নিয়ে আসা, স্বীকৃতি বা অনুমোদন ছাড়া স্কুল চলতে না দেওয়া, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না চালানো, পাবলিক পরীক্ষায় পাঁচ ঘণ্টার মূল্যায়ন অন্যতম।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ায় ২০১০ সাল থেকে অনেক স্কুল ডাবল শিফট চালু করে। কিন্তু তা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অনুকূল নয়। তাই আমরা তা তুলে দিতে বলেছি।
আমাদের এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১ঃ৪২ হলেও শহর এলাকার হাজারখানেক স্কুলে এই অনুপাত ১ঃ৭০। আমরা আগামী বছর এই অনুপাত ১ঃ৫৫ করার এবং পরের বছর থেকে প্রতিবছর পাঁচ করে কমিয়ে ১ঃ৪০-এ আনতে বলেছি।’
মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা স্কুলের একাধিক সেকশন কমাতে বলেছি। আমরা বলেছি, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া কোনো স্কুল চলবে না। বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেনগুলোর অনুমোদন নেই। ফলে তাদের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পান না। তাই আমরা ম্যাপিং করে যেসব স্কুল প্রয়োজন, সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে রাখতে বলেছি। বাকিগুলোকে অন্য স্কুলের সঙ্গে সমন্বয় করতে বলেছি।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে সামষ্টিক মূল্যায়নের চেয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নে অনেক বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শিখবে, সেখানেই তাদের মূল্যায়ন হবে। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের দেশের বড় স্কুলগুলোতে ডাবল শিফট পরিচালিত হয়। ফলে একটি ক্লাস কোনোভাবেই ৪০ মিনিটের বেশি নেওয়া সম্ভব হয় না। আবার স্কুলগুলোতে প্রতিটি ক্লাসে ৮০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থী থাকে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের উপযোগী পাঠদান কোনোভাবেই শ্রেণিকক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী বছর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণি (এন্ট্রি ক্লাস) থেকে দুই শিফটের অধীনে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরবর্তী বছর তা করা হবে সপ্তম শ্রেণি থেকে। এভাবে ধাপে ধাপে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই শিফটের সব ক্লাসেই (ষষ্ঠ-দশম) শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর দুই শিফটের অধীনে নতুন করে কোনো শিক্ষককে আর এমপিও দেওয়া হবে না।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে এনসিটিবি দুই শিফটের স্কুলগুলোতে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে। সেগুলো হলো নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিখন ঘণ্টা অনুসরণ না করা, মূল্যায়নে বাধাগ্রস্ত, শিক্ষকের কাজে ব্যাপক চাপ তৈরি, শিক্ষার্থীর শ্রেণির বাইরের কাজে বাধা সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে যানজটসহ সামাজিক অনেক সমস্যা তৈরি হওয়া।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দুই শিফটের মোট ৪৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি মাধ্যমিকে ১৬৫টি আর বেসরকারিতে ৩০০টি। দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট সাত লাখ ৫২ হাজার ৩৪১ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে সরকারিতে দুই লাখ ৭০ হাজার ২১৭ জন এবং বেসরকারিতে চার লাখ ৮২ হাজার ১২৪ জন। ডাবল শিফটের এসব স্কুল দেশে নামিদামি স্কুল হিসেবে পরিচিত।
দুই শিফটে থাকা স্কুলগুলোর প্রথম শিফটে ক্লাস চলে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত। দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস চলে ১২টা ১৫ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত। কিন্তু এক শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিঘণ্টা ছয় ঘণ্টা এবং ডাবল শিফটের চার ঘণ্টা ৩০ মিনিট। অথচ নতুন শিক্ষাক্রমে একটি শ্রেণি ঘণ্টার জন্য এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রয়েছে।
জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকদের হাতে নম্বর থাকায় কেউ উদার হাতে নম্বর দিচ্ছেন, আবার কেউ খুব কম নম্বর দিচ্ছেন। সামষ্টিক মূল্যায়ন বা পরীক্ষায় খুব কম নম্বর থাকায় তা সারা বছরের মূল্যায়নে তেমন প্রভাব রাখতে পারছে না। আর মূল্যায়নের গ্রেড ‘ত্রিভুজ’, ‘বৃত্ত’ ও ‘চতুর্ভুজক’ও পছন্দ করছেন না অভিভাবকরা। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়নেও পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০২৬ সালে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষা হবে। কিন্তু আগে তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হলেও ওই বছর থেকে প্রতিটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে পাঁচ ঘণ্টায়। দীর্ঘ এ সময় পরীক্ষার হলেই অবস্থান করতে হবে পরীক্ষার্থীদের। অবশ্য মাঝে বিরতি পাবে তারা।
পাবলিক পরীক্ষায় মোট ১০টি বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। বিষয়গুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি।
বিষয়ের চাহিদা ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রকল্পভিত্তিক কাজ, সমস্যা সমাধান, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদির পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে পরীক্ষার্থীদের। মূল্যায়নে অনুসন্ধান, প্রদর্শন, মডেল তৈরি, উপস্থাপন, পরীক্ষণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় থাকবে। পরীক্ষার মান ও মূল্যায়নে যাতে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা যায়, এ জন্য লিখিত মূল্যায়নে বর্তমান পাবলিক পরীক্ষার মতো খাতা ব্যবহার করা হবে।
জানা যায়, স্কুল-কলেজের একাধিক শাখা ক্যাম্পাস থাকায় শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। গভর্নিং বডি ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানরাও সব ক্যাম্পাসে ঠিকমতো নজর দিতে পারেন না। তাই স্কুল-কলেজের শাখা ক্যাম্পাস না রাখার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে যাদের বর্তমানে শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে, সেগুলোকে স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হবে।
যেমন—রাজধানীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারটি ক্যাম্পাস রয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বেইলি রোড; ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আজিমপুর; ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ধানমণ্ডি এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বসুন্ধরা হিসেবে পৃথকভাবে পরিচালিত হবে। তাদের পৃথক অনুমোদন, এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ইআইআইএন) ও আলাদা গভর্নিং বডি থাকবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বড় স্কুলগুলোর প্রতিটি শ্রেণিতে ৮০ থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এতে একজন শিক্ষকের রোল নম্বর ডাকতে ডাকতেই সময়ের বড় অংশ চলে যায়। এরপর কোনো পড়া বুঝিয়ে বলা শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ জন্য নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রতি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ৫৫ রাখার ব্যাপারে কাজ শুরু করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগামী বছর থেকে কোনো শ্রেণিতে নতুন করে ৫৫টির বেশি সিটের অনুমোদন দেওয়া হবে না।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম শামসুন নাহার বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতও হয়তো কাঙ্ক্ষিত মানে নেই। তবে শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসিএ কাজ করছে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ জন শিক্ষার্থীর বেশি ভর্তি করা উচিত নয়। সে বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’