৪০ ফুট নিচে নেমেছে পানির স্থিতিতল, দক্ষিণাঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট

barishal1-20240429174017.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক।।  বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কমপক্ষে পাঁচ লাখ লোকের বসবাস। এই জনগোষ্ঠির জন্য দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছিল ৩ কোটি ২০ লাখ লিটারের। ভূ-গর্ভস্থ পানি সরবারহের এই উৎস সিটি এলাকার অর্ধেক মানুষের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দুটি চালু না করতে পারায় ব্যক্তি পর্যায়ে গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দেয় নগর ভবন। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সাড়ে চার হাজারের অধিক গভীর নলকূপ বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়। বিপত্তি বাধে অন্যত্র। গ্রীষ্মকাল এলে নলকূপে পানি ওঠে না গত তিন বছর ধরে। যে কারণে বাধ্য হয়ে এবার সাবমারসিবল পাম্প স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

সিটি কর্পোরেশন বলছে, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু থাকলে পানি উত্তোলনের হিসেব থাকতো। ব্যক্তি পর্যায়ে সাবমারসিবল পাম্প বসানোয় কত কোটি লিটার পানি উত্তোলিত হচ্ছে তার হিসেব নেই।

এর বিপরীত চিত্র বরগুনা জেলার উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটায়। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা পাথরঘাটা পৌরসভার বাসিন্দা ৩০ হাজার। নদী, জল-জলাশয় বেষ্টিত এখানে এক গ্লাস নিরাপদ পানির জন্য সংগ্রাম করতে হয়।

পাথরঘাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হোসেন আকন বলেন, পৌরসভার বাসিন্দারা ডিপ টিউবয়েল বসিয়েও খাবার পানি তুলতে পারেন না। টিউবয়েলের পানি এত বেশি লবণাক্ত যে মুখে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। পৌরসভা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ভূ-গর্ভস্থ একটি উৎস থেকে পানির লাইন করে পৌরবাসীর জন্য সরবারহ করা হয়। যদিও তাতে পানির অভাব পূরণ হয় না। লোডশেডিংয়ের কারণে যথাসময়ে পানি লাইনে দিতে পারি না।

বরিশাল সিটি কর্পোরেশন বা পাথরঘাটা পৌর শহরই কেবল নয়, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরগুনায় সুপেয় পানির জন্য শঙ্কা দেখা দেয় শুকনো মৌসুম এলেই। অথচ শত শত নদী-খাল মাকড়সার জালের মতো এই জেলাগুলোর বুক চিড়ে প্রবাহিত হয়েছে। যে কারণে বরিশালকে জলের দেশও বলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ভোলায় পানির সংকট দেখা দেয়নি।

৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে পানির স্থিতিতল

গভীর নলকূপ স্থাপনের মিস্ত্রি হরগোবিন্দা সাহা বলেন, বরিশাল শহর ও শহর লাগোয়া কাশিপুর, চরকাউয়া, রায়পাশা-কড়াপুর, জাগুয়া, চরবাড়িয়া ইউনিয়নে পাঁচ বছর আগেও ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীরতায় সুপেয় পানির স্থিতিতল পাওয়া যেত। যা বর্তমানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৪০ ফুট গভীরে। যে সকল এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ এবং গভীর নলকূপ বেশি রয়েছে সেই সকল এলাকায় পানির স্তর পেতে অনেক গভীরে যেতে হয়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার ৪২টি উপজেলার মধ্যে ১৫০টিরও বেশি গ্রামে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। এছাড়া পৌর শহর, সিটি কর্পোরেশন এলাকায়তো রয়েছেই।

সুপেয় পানির জন্য কাজ করা উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের বরিশাল জোনের প্রধান বাদল হাওলাদার জানান, এখন পর্যন্ত পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও বরগুনার পাথরঘাটায় আমরা দুটি প্রকল্পে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করছি। ৩৫টি প্ল্যান্টে প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানি নিতে পারছে।

পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ইকরি ইউনিয়নের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, ফাল্গুন মাস এলেই আমাদের টিউবওয়েলের পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস এলে আবার স্বাভাবিক হয়। এ নিয়ে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি সাবমারসিবল বসাতে বলেছেন। মাটির নিচের খাবার পানির স্তর নিচে নেমে গেছে বলে জানিয়েছেন।

পাশের উপজেলা মঠবাড়িয়ার সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামের মিরাজ মিয়া বলেন, চৈত্রমাস এলে পুকুর খালের পাশাপাশি টিউবয়েলের পানিও শুকিয়ে যায়। এজন্য প্লাস্টিকের গ্যালন কিনেছি। বৃষ্টির সময়ে পানি ধরে রাখি। আবার পুকুরের পানি ফুটিয়েও পান করি।

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার মঠবাড়ী ইউনিয়নের পারভীন বেগম বলেন, টিউবওয়েলের পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাবমারসিবল বসিয়ে নিয়েছি। এখন আর পানির অভাব নেই।

মাহমুদ হাসান নামে পটুয়াখালীর এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, পৌর শহরে পানির সংকট প্রকট। পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের পাম্পে পানি উত্তোলন করলে ১ নং ওয়ার্ডের টিউববওয়েলগুলোতে পানি ওঠে না। এজন্য পৌর কর্তৃপক্ষ রাতে পানি তোলে আর বাসিন্দারা দিনে। দিনে দিনে বিভিন্ন কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।

দক্ষিণাঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার যে কারণে?

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বরিশাল বিভাগীয় অধিদপ্তর জানিয়েছে, ফসলের ক্ষেতে সেচের জন্য বিভাগের ছয় জেলায় ৭৫২টি পাম্প রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ২২২টি, ভোলায় ১৮৪টি, পিরোজপুরে ১০৩টি, ঝালকাঠিতে ৬৫টি, পটুয়াখালীতে ১১৮টি ও বরগুনায় ৬০টি। সরকারি এই পাম্পগুলোর সবগুলোই মাটির উপরিভাগের পানি সঞ্চালনের জন্য ব্যবহৃত বা সারফেস ওয়াটার পাম্প। দক্ষিণাঞ্চলে সাধারণত গ্রাউন্ড ওয়াটার পাম্পের প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও অনেকে নিজের সুবিধার জন্য গ্রাউন্ড ওয়াটার পাম্প ব্যবহার করেন তা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন অনুমোদিত নয় বা তার তথ্যও এই অধিদপ্তরের হাতে নেই।

বিএডিসি বরিশাল জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ ওয়াহিদ মুরাদ বলেন, সেচ পাম্পগুলো সাধারণত ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে না। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ের গভীর নলকূপ, সাবমারসিবল পাম্প ভূগর্ভস্থ পানি তুলছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. জামাল উদ্দিন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে পানির সংকট তৈরি হয়েছে নাতিদীর্ঘ অতীতে। এই অঞ্চলে অতিমাত্রায় কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে— সেই স্থাপনাগুলোতে ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ খাল, পুকুর দূষণ আর দখল করে ফেলছে। ১২ বছর আগেও বরিশালে যে পরিমাণে খাল, পুকুর আর জলাধার ছিল তার আনুমানিক ৭০ শতাংশ এখন নেই। একদিকে পানির উৎস বলতে সকল কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানির স্থিতিতল নিচে নেমে যাচ্ছে। স্থিতিতল পূরণের জন্য যে রিচার্জের উৎস উপরিভাগের খাল, পুকুর, জলাধার তা মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানির স্তর রিচার্জ হয়ে স্থিতিতল উপরে উঠতে পারছে না।

তিনি আরও বলেন, বায়ূমন্ডলে কোনো স্থানে বায়ুশূন্যতা দেখা দিলে চারপাশের বায়ু সেখানে প্রবেশ করে তা পূরণ করে। তেমনি ভূ-গর্ভস্থ পানি অতিমাত্রায় তুলে ফেলায় শূন্যতলে চারদিকের পানি ঢুকে পড়ছে। পরিশোধনের আগেই ভূ-উপরিতলের স্যালাইন ওয়াটার ঢুকে পড়ছে। যেজন্য গর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। মূলত দক্ষিণাঞ্চলে সুপেয় পানির যে সংকট দেখা দিচ্ছে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে মানুষ দায়ী।

আরেক বিশেষজ্ঞ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক মনে করেন, শুধু ভূ-গর্ভস্থ পানি তোলাই কারণ নয়, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ফারাক্কা বাঁধ।

তিনি বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানির যে রিসোর্স— এটা শেষ হয়ে যেতে পারে এগুলো মানুষ বিবেচনা করে না। গত ২০-৩০ বছরে দক্ষিণাঞ্চলের নদী-খালগুলোর গভীরতা কমে গেছে। বাংলাদেশর ভাটি এলাকার জনপদ। উজান থেকে যে পানি আসতো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে তা জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে ফারাক্কা বাঁধ করে। সুতরাং সুপেয় পানির জন্য যে হাহাকার চারদিকে শুরু হয়েছে সেই পরিস্থিতির জন্য সর্ব প্রথম দায়ী ফারাক্কা বাঁধ। নদীগুলো শুকিয়ে গেছে, নাব্যতা হারিয়েছে, নদীর ক্যাচমেন্ট ফ্লো নষ্ট করে দিয়েছে ফারাক্কা বাঁধ। ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর এই ৫০ বছরে আমাদের নদীগুলোর যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, পদ্মা, যমুনার মতো নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ফারাক্কা না থাকলে এমন অবস্থায় যেতে আমাদের অন্তত ৭শ বছর লাগতো। তার মানে যা আমাদের ৭শ বছরে হতো একটি বাঁধ সেখানের সাড়ে ৬শ বছরের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিয়েছে। ফারাক্কার কারণে আমাদের সারফেস ওয়াটার রিসোর্স ধ্বংস হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, মানুষ সকল কাজে গ্রাউন্ড ওয়াটার বেশি ব্যবহার করছেন। কিন্তু সেই তুলনায় রিচার্জ হচ্ছে না। যে কারণে গ্রাউন্ড ওয়াটার নিচে নেমে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

ড. হাফিজ আশরাফুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সুপেয় পানির জন্য দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ একটি বিপর্যয়ের কাছাকাছি রয়েছে। তিনি সকল কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে শুধু খাওয়ার জন্য এই পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।

যা বলছে কর্তৃপক্ষ

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বরিশাল জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ইমরান তরফদার বলেন, নদী-খাল ও জলাধার বেষ্টিত বরিশাল বিভাগে সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে এটি দুঃখজনক। এই সংকট সৃষ্টির পেছনে আসলে ব্যবহারকারীরাই দায়ী। শিল্প কারখানা, কৃষিজমি, দৈনন্দিন সকল কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়।

তিনি বলেন, সকল কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সুপেয় পানি পাওয়ার সংকট আমরাই তৈরি করছি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বরিশাল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এসএম শহিদুল ইসলাম বলেন, বিগত ৩-৪ বছর ধরে গ্রীষ্মকাল এলেই বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল নিচে নেমে যাওয়ায় এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এজন্য গভীর নলকূপেও সহজে পানি উঠানো যাচ্ছে না। যে সকল এলাকায় এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে সেখানে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হচ্ছে। কারণ অনেক স্থানে পানির হার্ডলেয়ার দেখা দেয়। বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া আসলে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও বর্ষা মৌসুম এলে পানির স্থিতিতল উপরিভাগে উঠে আসে। তখন সমস্যা লাঘব হয়। যুক্ত করেন এই কর্মকর্তা।

 

 

Share this post

PinIt
scroll to top