‘মুসলিম লীগ নয়, ভারত ভেঙেছে কংগ্রেস’: মাওলানা আজাদ (পরবর্তী অংশ)

04d2b64e-6aca-4874-93c2-f8e358d7734c.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক।। নেহরু সম্পর্কে মাওলানা আজাদ তাঁর গ্রন্থে একটি চাঞ্চল্যকর বক্তব্য দিয়েছেন:
“যারা আমাদের প্রশংসা করেন, আমরা সকলেই তাদের পছন্দ করি। কিন্তু জওহরলাল সম্ভবত তাঁর প্রশংসাকারীদের অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই পছন্দ করতেন।”

মাওলানা আজাদ বিশ্বাস করতেন যে, কৃষ্ণ মেনন তার ব্রিটিশপন্থী প্রবণতার সাহায্য নিয়ে মাউন্টব্যাটেনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং মাউন্টব্যাটেন নেহরুর ওপর তাঁর প্রভাব খাটান ভারত-বিভাগ মেনে নিতে।

আজাদ এ সম্পর্কে লিখেছেন:
“যখন অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হয়, তখন জওহরলাল কৃষ্ণ মেননকে লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লর্ড ওয়াভেল এতে রাজি হননি। ব্রিটিশ সরকারও কৃষ্ণ মেননের নিয়োগ যথাযথ হবে না বলে পরামর্শ দেয়। এর কিছুদিন পরই লর্ড ওয়াভেল ভারত ত্যাগ করেন এবং কৃষ্ণ মেনন লন্ডন থেকে ভারতে আসেন। তিনি জওহরলালের সঙ্গে অবস্থান করেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, কৃষ্ণ মেননের প্রতি জওহরলালের দুর্বলতা রয়েছে এবং তার মাধ্যমে তিনি জওহরলালকে প্রভাবিত করতে পারবেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন মেননের পৃষ্ঠপোষকতা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে বেশ ক’বার ভাইসরয়ের বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। কমিউনিজমের প্রতি ঝোঁক ছিল কৃষ্ণ মেননের। কিন্তু তিনি যখন দেখতে পান যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার প্রতি বন্ধুভাবপন্ন এবং তাকে একটি পদে আসীন করার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারবেন, তখন তিনি রাতারাতি ব্রিটিশপন্থী হয়ে যান। তিনি ব্রিটিশের প্রতি তার বন্ধুসুলভ অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে মাউন্টব্যাটেনের মন জয় করতে সক্ষম হন।

“অন্যদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন মনে করেন যে, তাঁর ভারত-বিভাগ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে জওহরলালকে সম্মত করানোর ব্যাপারে কৃষ্ণ মেননকে সফলতার সঙ্গে কাজে লাগানো যেতে পারে। এটা আমার বিশ্বাস যে, এই প্রশ্নে জওহরলালের মনে মেনন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এর অল্প কিছুদিন পরই যখন আমি জানতে পারি যে, জওহরলাল যদি মেননকে লন্ডনে ভারতের হাই কমিশনার নিয়োগ করতে চান, তাহলে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাকে সমর্থন করবেন, তখন আমি অবাক হইনি।”

মাউন্টব্যাটেন তার পরবর্তী জীবনে ভারত-বিভাগ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভয়াবহতার জন্য সরাসরি জিন্নাহ ও মুসলিম লীগকে দোষারূপ করলেও মাওলানা আজাদের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে মাউন্টব্যাটেনের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত ছিল।

তিনি লিখেছেন:
“লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিস্থিতি পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। সদস্যদের মতানৈক্যের কারণে তিনি ধীরে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে পূর্ণ ক্ষমতা হাতে নেন। তখনও তিনি সাংবিধানিক গভর্নর জেনারেল ধরনের সরকার ব্যবস্থা ধরে রেখেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে মধ্যস্থতার কাজ শুরু করেও বাস্তবে তিনি নিজের পথেই ছিলেন। এছাড়া তিনি রাজনৈতিক সমস্যার একটি নতুন দিক নির্দেশনা দিতে শুরু করেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়কে পাকিস্তানের অনিবার্যতা সম্পর্কে বোঝাতে চেষ্টা করেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন এবং তাঁর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের কংগ্রেস সদস্যদের মনে এই ধারণার বীজ বপন করেন –।

“তিনি ইতিহাসে এমন এক ব্যক্তি হিসেবে স্মরণীয় হতে চেয়েছিলেন, যিনি ভারতের সমস্যার সমাধান করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, যদি সমাধানটি তাঁর উদ্ভাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়, তাহলে তিনি আরও কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারবেন। আমার মনে হয়, এই পরিবর্তনের জন্য দেশ-বিভাগ সম্পর্কে নেহরুর দৃষ্টিভঙ্গি) একটি বিষয় দায়ী ছিল, তা হচ্ছে লেডি মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিত্ব।

“লর্ড মাউন্টব্যাটেন আমাকে ধারণা দিয়েছিলেন যে, ভারত-বিভাগ সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো চিত্র নিয়ে তিনি লন্ডনে যাচ্ছেন না, এবং তিনি কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা পুরোপুরি বাতিলও করছেন না। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে আমার ধারণা পরিবর্তনে বাধ্য করে। এরপর তিনি যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেন, তা আমাকে নিশ্চিত করে যে, তিনি ইতোমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছিলেন এবং দেশ বিভাগ সম্পর্কে তার পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য ব্রিটিশ কেবিনেট রাজি করানোর জন্য তিনি লন্ডন যাচ্ছেন।”

ভারত-বিভাগের জন্য শেষ যে ব্যক্তিটিকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অভিযুক্ত করেন, তিনি সরদার বল্লভভাই প্যাটেল।

তিনি লিখেছেন:
“আমি বিস্মিত হই যে, এখন প্যাটেল এমনকি জিন্নাহ’র চেয়েও দ্বি-জাতি তত্ত্বের বড় সমর্থক। জিন্নাহ দেশ-বিভাগের পতাকা তুলে ধরতে পারেন, কিন্তু এখন আসল পতাকা বহনকারী হচ্ছেন বল্লভভাই প্যাটেল। এমনকি দৃশ্যপটে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের আবির্ভাবের আগেই সরদার প্যাটেল দেশ-বিভাগের পঞ্চাশ শতাংশ অনুকূলে ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, তার পক্ষে মুসলিম লীগের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি যদি কেবল মুসলিম লীগ থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারেন, তাহলে তিনি ভারতের একটি অংশ গ্রহণ করার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন। একথা বলা হয়তো ভুল হবে না যে, বল্লভভাই প্যাটেলই ছিলেন ভারত-বিভাগের মূল উদ্যোক্তা —-। এখন এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে আমরা দেশ-ভাগের ব্যাপারে আমরা জিন্নাহ’র চেয়েও বড় সমর্থক হয়ে উঠছি।”

জিন্নাহর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মাঝেও এর প্রমাণ যায়। ভারত-বিভাগের পর জিন্নাহ করাচিতে ওই সময়ের তরুণ সিন্ধি নেতা হাশু কেওয়াল রামানিকে বলেছিলেন: “আমি কখনোই এই জঘন্য দেশ-ভাগ চাইনি! এটা সরদার প্যাটেল আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এখন তারা চায় যে, আমি সামান্য পিঠা খেয়ে পরাজয় স্বীকার করার ভঙ্গিতে আমার হাত ওপরে তুলে ধরি।”

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, যিনি অখণ্ড ভারত এবং সেই ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের এক মায়ের দুই সন্তানের মতো বসবাস করার পক্ষে মুসলমানদের সারাজীবন নসিহত করেছেন, যাকে জিন্নাহ ও তার দল মুসলিম লীগের সকল পর্যায় থেকে ‘কংগ্রেসের শো-বয়” কটাক্ষ করা হয়েছে, যিনি জওহরলাল নেহরুর আগে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি ভারত-বিভাগের জন্য জিন্নাহকে দায়ী করেননি, দায়ী করেছেন জওহরলাল নেহরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ও লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে। এই দোষারূপ তিনি লিখিত আকারেই করে গেছেন তার জীবদ্দশায়। কিন্তু কংগ্রেসে তাঁর বন্ধুরা যাতে তাঁর সত্য প্রকাশের কারণে মনোকষ্ট ভোগ না করেন, সেজন্য তাঁর আত্মজীবনীর ৩০টি বিস্ফোরক পৃষ্ঠা আত্মজীবনীতে সংযোজন না করে তার মৃত্যুর ৩০ বছর পর রেখে যাওয়া অংশটুকু আত্মজীবনীতে সংযোজন করার অসিয়ত করে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় তাঁর জুনিয়র হুমায়ুন কবীরকে, যিনি মাওলানা আজাদের উর্দু বক্তব্যের নোট নিতেন এবং তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে মাওলানাকে দেখাতেন। তিনি তাকে বলেন অপ্রকাশিত ৩০ পৃষ্ঠা ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা (ন্যাশনাল আর্কাইভ) এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বাক্সবন্দি করে রাখার জন্য। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর ১৯৮৮ সালে পৃষ্ঠাগুলো “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম” গ্রন্থে সংযোজিত হয়ে ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ ওই সময়ের মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মীরা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আত্মজীবনীতে অপ্রকাশিত ৩০ পৃষ্ঠা সংযোজিত হওয়ার আগে এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল এবং বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। (এর ওপর পরবর্তীতে কখনও আলোকপাত করবো বলে আশা করি।)

কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মাওলানা আজাদের আত্মজীবনীর সংযোজিত অংশ নিয়ে খুশি হতে পারেননি। কারণ পাকিস্তানের স্রষ্টা ও পাকিস্তানি জাতির পিতা জিন্নাহ পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার এক বছর পরই মারা যান এবং তিনি কোনো আত্মজীবনীও লিখে যাননি। অতএব, পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদরা তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে গেছেন যে কবি আল্লামা ইকবাল পাকিস্তানের ধারণা দিয়েছিলেন, যে কারণে তাঁকে পাকিস্তানের ‘স্বপ্নদ্রষ্টা কবি’ বলা হয় এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এককভাবে কবি ইকবালের ধারণাকেই বাস্তবায়ন করেছেন। করেছিলেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, কবি ইকবাল অথবা জিন্নাহ কেউই ভারতের বাইরে তাদের পাকিস্তান কল্পনা করেননি। ইকবাল সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি পাকিস্তানের যে পরিকল্পনা দিয়েছেন তার অর্থ ভারতের মধ্যে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র।

জিন্নাহ কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়টিকে কেবল ওইসব বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুক্তি প্রদর্শন করে আসছেন যে, জিন্নাহ ভারত-বিভাগের বলিষ্ঠ ও আপসহীন প্রবক্তা ছিলেন। জিন্নাহ’র কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন এবং তাঁর অগ্রাধিকারগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি শেষ পর্যন্ত একটি সাম্প্রদায়িক সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক নিস্পত্তির ব্যাপারেই প্রতিশ্রুিিতবদ্ধ ছিলেন। তাছাড়া জিন্নাহকে উপমহাদেশের ইতিহাসে একমাত্র রাজনীতিবিদ যাকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সেরা দূত’ অভিহিত করা হয়েছে।

ইয়াসির হামদানি তার “জিন্নাহ: অ্যা লাইফ” গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন যে, একটি পর্যায়ে জিন্নাহ এমনকি একথাও বলেছেন, “আমি প্রথমত ভারতীয়, দ্বিতীয়ত একজন ভারতীয় এবং শেষপর্যন্ত আমি একজন ভারতীয়।” পাকিস্তানি ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রূপকথাতূল্য কাহিনিতে যিনি ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ ছিলেন, তাকে সহসা একজন একগুঁয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীতে পরিণত করা হয়েছিল, যা তিনি ছিলেন না। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বিবরণ এই সত্যের একটি স্পষ্ট স্বীকারোক্তি যে, “মুসলিম লীগ নয়, ভারত ভেঙেছে কংগ্রেস।”

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আত্মজীবনী “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম” পরিপূর্ণ সংস্করণে ভারত বিভাগের ওপর কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের, বিশেষ করে নেহরু ও প্যাটেলের মনোভাবের মূল সুর ও চেতনা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের বেছে নেয়া কঠিন পথ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ৭৬ বছর আগে উপমহাদেশকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে বিদায় নেয়ার পরও উভয় দেশের পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো, একে অপরকে হুমকি প্রদান এবং দুই দেশের মধ্যে সার্বক্ষণিক যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করার পরিস্থিতি থেকে উপলব্ধি করা যেতে পারে যে, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অমূলক ছিল না। ভারত-বিভাগ নিয়ে ইতিহাসে পক্ষপাতহীন ও বিভ্রান্তিমুক্ত কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরা কিছুটা বিভ্রান্তমুক্ত হতে চাইলে ভারতের অন্যতম শীর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আজাদের আত্মজীবনী “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম” পাঠ করতে পারেন।

লেখক : সা‌বেক বার্তা সম্পাদক, দৈ‌নিক বাংলার বাণী।

Share this post

PinIt
scroll to top