স্বপ্নের শ্মশান ওই রানা প্লাজা

taslima-aktar-rana-plaza-20240424100506.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক।। টিনের বেড়া আর কাঁটাতারের সীমানা দিয়ে ঘেরা চারপাশ। ওপারের ঘেরাটোপের মাঝে বিশাল জায়গা জুড়ে এক শ্মশান, যেখানে বালু-পাথর, কংক্রিটের টুকরোর মাঝে মিশে আছে মানুষের দেহাবশেষ। একটু খোঁড়াখুঁড়ি করলেই হয়তো হঠাৎ ভয় পাইয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়বে কারও দাঁত-কপাটি, কশেরুকা, হাড়, কিংবা খুলি।

শ্মশানের মাটিতে এবড়োথেবড়ো ছোট ছোট ঢিবি, পাশে খানাখন্দ। চারপাশে ছড়িয়ে আছে লাল-নীল-বেগুনি ছিন্নভিন্ন খণ্ড খণ্ড নানা রংয়ের কাপড়ের টুকরো, যেমন খণ্ড খণ্ড হয়েছে মানুষের শরীর। পড়ে আছে সুতা, হাজার হাজার বোতাম, কারও ব্যাগ, রক্তমাখা কাপড়, আর নানা নামের বিদেশি ট্যাগ। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে ভীষণ প্রলয়ঙ্করী এক ঝড়ে তছনছ হওয়া এক বিস্তীর্ণ এলাকা। ২৪ এপ্রিল ২০১৩-এর চিহ্ন এসব।

ওইদিনে রানা প্লাজায় লণ্ডভণ্ড হয়েছে মানুষ-মেশিন, লোহা-লক্কড়, বালু-সিমেন্টের সাথে হাজার হাজার স্বপ্ন। সেইদিনের সেই ঝড় আর কিছু নয়, নয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ কিংবা কোনো ষড়যন্ত্রকারী দলের ভবন ধরে টানাটানির ফল; বরং কিছু মানুষ, গোষ্ঠী আর রাষ্ট্রের অমনোযোগ-অবহেলায় তৈরি এই ঝড়। যে ঝড়ের আরেক নাম হত্যাকাণ্ড। কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।

২৪ এপ্রিল হাজারো চেষ্টায় ভুলবার নয়। ২০১৩ সালের ওইদিনে রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকা থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে সাভার অঞ্চলে অবস্থিত রানা প্লাজার ভবনধসে মারা পড়ে প্রায় নিহত নিখোঁজসহ ১১৭৫ জনেরও (সূত্র : বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির গবেষণা) বেশি শ্রমিক। যার মধ্যে এখনো নিখোঁজ আছে ১৬২ জনের ওপর। ওইদিন খুব ভোরে দল বেঁধে এসেছিল ওরা। একে একে উঠেছিল নিউ ওয়েভ বটম লি:, ফ্যান্টম অ্যাপারেল, ফ্যান্টম টেক, ইথারটেক্স এবং নিউওয়েভ স্টাইলের মোট পাঁচটি কারখানায়।

তিন তলা থেকে আট তলা পর্যন্ত এক একটি কারখানা। নয় তলা ভবনের নিচের দুই তলায় দোকানপাট, ব্যাংক, মার্কেট আর ওপরের তলা ফাঁকা, মাঝখানে পাঁচ-পাঁচটি কারখানা। ‘দানব’ জেনারেটরগুলো নিচতলার বদলে ছিল তিন তলা আর আট তলায়। বিল্ডিংয়ের বাইরের অংশের নীলাভ কাঁচের দেয়াল দেখে ভেতরের নড়বড়ে অবস্থা বোঝার উপায় নেই কারও।

রবীন্দ্রনাথ সরকারসহ আরও কার কার জমি অবৈধভাবে দখল করে ওখানে গড়ে উঠেছিল ‘রানা প্লাজা’ ভবন! সোহেল রানার পরিবারের আবার পরের জমি দখলের সুখ্যাতি আছে। স্থানীয়রা প্রথম প্রথম ভয়ে মুখ খুলতো না, বলতো, ‘তাকে (সোহেল রানা) নিয়ে কিছু বললে তো মহা বিপদ, তার ওপর স্থানীয় এমপি মুরাদ জং-এর সুনজর আছে। পরে এসব বলার জন্য কী বিপদ আসে আমাদের, কে জানে!’

যাক যে কথা বলছিলাম, আগের দিন নানা খবর শুনে কারখানা পর্যন্ত পৌঁছে নানা আতঙ্ক কাজ করছিল শ্রমিকদের। কিন্তু প্রশাসনের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত কাজে ঢুকলো সবাই। শ্রমিকদের জীবনের চেয়ে মালিকের কাছে শিপমেন্ট অনেক জরুরি, নিরুপায় শ্রমিক না জেনে না বুঝে কাজে হাত দেয়।

হঠাৎ তুফানের মতো শব্দ করে চারদিক মুহূর্তে দেবে যেতে থাকে। যেন কবরের মধ্যে আটকা পড়ে সবাই। অনেক চেষ্টা করলো, দোয়া-কালাম পড়লো, স্রষ্টার কাছে জীবন ভিক্ষা চাইলো, কিন্তু কিছুতেই রেহাই মিললো না। কেউ চিৎকারে চিৎকারে ক্লান্ত হলো, কেউ অজ্ঞান হলো একটু পরপর।

চোখ খুলে মোবাইলের আলোতে দেখলো মেশিন আর কংক্রিটের নিচে লাইন ধরে পড়ে আছে কাজ করা মানুষগুলো। কোথাও দেয়াল ঘেঁষে পড়ছে রক্তের ফোঁটা। কারও সিঁড়ির নিচে কেবল পা দুটো বাইরের দিকে ঝুলে আছে। কারও পেট ফুটো হয়ে বেরিয়ে আছে লোহার রড। কেউ দেখলো একসারি পা অথবা একসারি মাথা, ছিন্নভিন্ন শরীর। তারা সব মৃত।

বেঁচে থাকা মানুষগুলো এখানে সেইখানে আটকে, কেউ বিমের নিচে ভীত-সন্ত্রস্ত, কারও চুল মেশিনের মধ্যে জড়িয়ে আছে। অন্ধকারে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করলো। নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান, বাঙালি-সাঁওতাল কোনো কিছুর ‘বিভেদ’ তখন চিন্তার ধারেকাছেও ছিল না।

মৃত্যুকূপ থেকে দুইদিন পরে বেরিয়ে আসা শ্রমিক জেসমিনের কথায় তা আরও স্পষ্ট হয়। জেসমিন বলে, ‘এমনভাবে আটকে ছিলাম, বাঁচার কোনো আশা ছিল না। একজন অচেনা পুরুষ তার বুকের মধ্যে আমাকে আগলে ধরে ছিল। একজন মহিলা মানুষ হয়ে পরপুরুষের বুকের মধ্যে আশ্রয় খোঁজা খুব সহজ না। তখন বেঁচে থাকার চরম ইচ্ছা ছাড়া, আমার মেয়েকে একবার দেখার ইচ্ছা ছাড়া লাজলজ্জা কোনোকিছু মাথায় আসেনি। আমি সারা জীবন দোয়া করি সেই ভাইকে, যার জন্য আমি এখনো বেঁচে আছি।’

এখানেই শেষ নয়, একজনের গায়ের ওপর এসে পড়লো অন্যজনের রক্ত, ভুঁড়ি, লাশ। তখন মরা মানুষের গন্ধ লাগেনি, কেবল মৃত্যুকূপ থেকে কখন বের হতে পারবে সেই ভাবনাই কাজ করেছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীরের ঘাম নিজেই চেটে খেল ওরা। একজনের প্রস্রাব আরেকজন খেল, তবু প্রাণে সইলো না।

রোজিনা নিজেই নিজের হাত কাটতে শুরু করলেন। ওর মতো এমনি করে রক্ষা পেল কেউ কেউ। বাঁচার আর কোনো সুযোগ নেই দেখে কারও কারও কাছে ইমাম পাঠিয়ে কলেমাও পড়ানো হলো। শেষ পর্যন্ত বিমের মধ্যে আটকে থাকা বাদবাকি মানুষগুলো পাগল হয়ে একজন আরেকজনার চুল ধরে টান মারলেন, খামচি মারলেন। মরণ কামড় পর্যন্ত দিলেন বেঁচে থাকার শেষ আশায়।

জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় ছটফট করেছেন তারা, বেঁচে থাকার প্রার্থনা করে রানা প্লাজার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলেছেন। এদের মধ্যে উদ্ধার পান কেউ কেউ। আর আটকা পড়া বন্দিরা ১৭ দিন ধরে ওই মৃত্যুকূপে যুদ্ধ করে প্রাণ হারায় এক এক করে।

ঘটনার নির্মমতায় রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে অন্যসব কারখানার শ্রমিক সহযোদ্ধারাও, বিচার চায় এই ঘটনার। কিন্তু রেহাই পায় না পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে। ঘটনার পর রানা প্লাজার আশেপাশে সাভার, আশুলিয়াসহ দেশের অন্যান্য পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রকাশ করলে সরকার-বিজিএমইএ বসে বসে তার মধ্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজে।

বিস্ময় যে, এত বড় ঘটনার পর শ্রমিকদের এই ফেটে পড়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার তৎপরতাকে স্বাভাবিকভাবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার-বিজিএমইএ। ২০ দিনের মাথায় মোনাজাত করে উদ্ধার কাজের সমাপ্তি ঘোষণা এলো। ওই ঘোষণায় অনেকের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছিল, বিশেষভাবে যারা তাদের সন্তানকে খুঁজে পাননি, তেমনি শত শত শ্রমিক পরিবার মানতে পারেনি এই ঘোষণা।

লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী অনেকেই ছুটে গেছেন খবর পেয়ে। শ্রমিকরা বিভিন্ন এলাকার মোড়ে জমায়েত হয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে চাইলে তাদের লাঠিপেটা করে শায়েস্তা করা হয়। পুলিশ, আর্মির কড়া প্রহরা ঠেলে কেউই থামাতে পারেনি সেই সিদ্ধান্ত।

এরপরে পুরো জায়গা জুড়ে ক্রমে নিরাপত্তা বেষ্টনী কঠোর হয়েছে, যাতে কেউ আর ভবনের ধ্বংসস্তূপে ঢুকতে না পারে। ধীরে ধীরে নিরাপত্তা বেষ্টনী আগের চেয়ে বেশি দুর্বল হয়েছে। পথশিশু, উদ্ধারকর্মী, শ্রমিক পরিবারের সদস্যসহ অনেকেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করেছে হাড়-কঙ্কাল-খুলি। কিছুদিন যেতেই, প্রতিদিন রাত গভীর থেকে ভোর অব্দি, এমনকি দিনের বেলায়ও; পুলিশের লোক দেখানো বাঁশির শব্দ শোনার আগ পর্যন্ত, ওই জায়গায় রড-সিমেন্ট, লোহা লক্কড়ের মাল-মসলা কাপড়ের সাথে লোপাট হয়েছে নানা আলামত।

সাধারণ মানুষ, স্বজন, উদ্ধারকর্মীরা ওই শ্মশানে উদ্ধারকাজ চালানোর চেষ্টা চালালেও বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু ‘কে বা কারা’ কোনো বাধা পায়নি। দফায় দফায় হাড়-কঙ্কাল বেরুলেও আনুষ্ঠানিকভাবে আর উদ্ধার কাজ হয়নি। আর কত! সরকার, পুলিশ প্রশাসন, বিজিএমইএ, সেনাবাহিনী সবাই ক্লান্ত। কত, আর কত হাড্ডি, কত লাশ, কত দায়! ওগুলো মানুষের নয়, গরুর হাড্ডি বলে তাই দায় এড়ানোর চেষ্টা চালায় পুলিশ।

প্রাণে মারা গেছে সরকারি ঘোষণা মতে ১১৩৬। কিন্তু নিহত, নিখোঁজ আর ডিএনএর হিসাব কষে আমরা দেখেছি প্রায় ১১৭৫-এর বেশি শ্রমিক মারা গেছেন এই ধসে। অদ্ভুত যে এত মানুষ নাই হয়ে যাওয়ার পরও আজ পর্যন্ত রানা প্লাজার পাঁচটি কারখানায় মোট ক’জন শ্রমিক কাজ করতেন, ক’জন নিহত, ক’জন নিখোঁজ তার কোনো প্রকৃত হিসাব মেলেনি।

শ্রমিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন, অন্যান্য সংস্থা তাদের উদ্যোগে যেসব নিখোঁজ তালিকা তৈরি করেছে সেইসবের কোনো সমন্বয় হয়নি। সরকার-বিজিএমইএ-এর প্রকৃত তালিকা তৈরির অনীহা দেখে মনে হয় তারা বলতে চাইছে—‘ওদের নাম-পরিচয়-এতসব তথ্য-তালাশের কী আছে? ওরা তো এমপি, মন্ত্রী, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, আমলা কেউই না; ওরা প্রাণ নয় সংখ্যা, ওরা শ্রমিক, টাকা তৈরির নাটবল্টু। ওদের পরিচয় তালিকা নিয়ে ভাববার সময় কই সরকার-মালিক আর বিদেশি ক্রেতাদের।’ স্পেকট্রাম থেকে রানা প্লাজা এত বছরের ঘটনাগুলোয় পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি, বিশেষভাবে নিখোঁজদের তালিকা।

কারখানা ইতিহাসের এই নিষ্ঠুরতম ঘটনার শিকার মানুষগুলোর জীবন সরকার-মালিক-বিদেশি বায়ারদের কাছে অগুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশের নাগরিকদের কাছে কি তাই? রানা প্লাজার শ্রমিকরা তো এদেশেরই নাগরিক।

দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এরাই তো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ‘নাই’ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আমাদের কি থাকে?

রবীন্দ্রনাথ সরকারসহ আরও কার কার জমি অবৈধভাবে দখল করে ওখানে গড়ে উঠেছিল ‘রানা প্লাজা’ ভবন! সোহেল রানার পরিবারের আবার পরের জমি দখলের সুখ্যাতি আছে। স্থানীয়রা প্রথম প্রথম ভয়ে মুখ খুলতো না, বলতো, ‘তাকে (সোহেল রানা) নিয়ে কিছু বললে তো মহা বিপদ, তার ওপর স্থানীয় এমপি মুরাদ জং-এর সুনজর আছে। পরে এসব বলার জন্য কী বিপদ আসে আমাদের, কে জানে!’

যাক যে কথা বলছিলাম, আগের দিন নানা খবর শুনে কারখানা পর্যন্ত পৌঁছে নানা আতঙ্ক কাজ করছিল শ্রমিকদের। কিন্তু প্রশাসনের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত কাজে ঢুকলো সবাই। শ্রমিকদের জীবনের চেয়ে মালিকের কাছে শিপমেন্ট অনেক জরুরি, নিরুপায় শ্রমিক না জেনে না বুঝে কাজে হাত দেয়।

হঠাৎ তুফানের মতো শব্দ করে চারদিক মুহূর্তে দেবে যেতে থাকে। যেন কবরের মধ্যে আটকা পড়ে সবাই। অনেক চেষ্টা করলো, দোয়া-কালাম পড়লো, স্রষ্টার কাছে জীবন ভিক্ষা চাইলো, কিন্তু কিছুতেই রেহাই মিললো না। কেউ চিৎকারে চিৎকারে ক্লান্ত হলো, কেউ অজ্ঞান হলো একটু পরপর।

চোখ খুলে মোবাইলের আলোতে দেখলো মেশিন আর কংক্রিটের নিচে লাইন ধরে পড়ে আছে কাজ করা মানুষগুলো। কোথাও দেয়াল ঘেঁষে পড়ছে রক্তের ফোঁটা। কারও সিঁড়ির নিচে কেবল পা দুটো বাইরের দিকে ঝুলে আছে। কারও পেট ফুটো হয়ে বেরিয়ে আছে লোহার রড। কেউ দেখলো একসারি পা অথবা একসারি মাথা, ছিন্নভিন্ন শরীর। তারা সব মৃত।

বেঁচে থাকা মানুষগুলো এখানে সেইখানে আটকে, কেউ বিমের নিচে ভীত-সন্ত্রস্ত, কারও চুল মেশিনের মধ্যে জড়িয়ে আছে। অন্ধকারে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করলো। নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান, বাঙালি-সাঁওতাল কোনো কিছুর ‘বিভেদ’ তখন চিন্তার ধারেকাছেও ছিল না।

মৃত্যুকূপ থেকে দুইদিন পরে বেরিয়ে আসা শ্রমিক জেসমিনের কথায় তা আরও স্পষ্ট হয়। জেসমিন বলে, ‘এমনভাবে আটকে ছিলাম, বাঁচার কোনো আশা ছিল না। একজন অচেনা পুরুষ তার বুকের মধ্যে আমাকে আগলে ধরে ছিল। একজন মহিলা মানুষ হয়ে পরপুরুষের বুকের মধ্যে আশ্রয় খোঁজা খুব সহজ না। তখন বেঁচে থাকার চরম ইচ্ছা ছাড়া, আমার মেয়েকে একবার দেখার ইচ্ছা ছাড়া লাজলজ্জা কোনোকিছু মাথায় আসেনি। আমি সারা জীবন দোয়া করি সেই ভাইকে, যার জন্য আমি এখনো বেঁচে আছি।’

এখানেই শেষ নয়, একজনের গায়ের ওপর এসে পড়লো অন্যজনের রক্ত, ভুঁড়ি, লাশ। তখন মরা মানুষের গন্ধ লাগেনি, কেবল মৃত্যুকূপ থেকে কখন বের হতে পারবে সেই ভাবনাই কাজ করেছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীরের ঘাম নিজেই চেটে খেল ওরা। একজনের প্রস্রাব আরেকজন খেল, তবু প্রাণে সইলো না।

রোজিনা নিজেই নিজের হাত কাটতে শুরু করলেন। ওর মতো এমনি করে রক্ষা পেল কেউ কেউ। বাঁচার আর কোনো সুযোগ নেই দেখে কারও কারও কাছে ইমাম পাঠিয়ে কলেমাও পড়ানো হলো। শেষ পর্যন্ত বিমের মধ্যে আটকে থাকা বাদবাকি মানুষগুলো পাগল হয়ে একজন আরেকজনার চুল ধরে টান মারলেন, খামচি মারলেন। মরণ কামড় পর্যন্ত দিলেন বেঁচে থাকার শেষ আশায়।

জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় ছটফট করেছেন তারা, বেঁচে থাকার প্রার্থনা করে রানা প্লাজার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলেছেন। এদের মধ্যে উদ্ধার পান কেউ কেউ। আর আটকা পড়া বন্দিরা ১৭ দিন ধরে ওই মৃত্যুকূপে যুদ্ধ করে প্রাণ হারায় এক এক করে।

ঘটনার নির্মমতায় রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে অন্যসব কারখানার শ্রমিক সহযোদ্ধারাও, বিচার চায় এই ঘটনার। কিন্তু রেহাই পায় না পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে। ঘটনার পর রানা প্লাজার আশেপাশে সাভার, আশুলিয়াসহ দেশের অন্যান্য পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রকাশ করলে সরকার-বিজিএমইএ বসে বসে তার মধ্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজে।

বিস্ময় যে, এত বড় ঘটনার পর শ্রমিকদের এই ফেটে পড়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার তৎপরতাকে স্বাভাবিকভাবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার-বিজিএমইএ। ২০ দিনের মাথায় মোনাজাত করে উদ্ধার কাজের সমাপ্তি ঘোষণা এলো। ওই ঘোষণায় অনেকের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছিল, বিশেষভাবে যারা তাদের সন্তানকে খুঁজে পাননি, তেমনি শত শত শ্রমিক পরিবার মানতে পারেনি এই ঘোষণা।

লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী অনেকেই ছুটে গেছেন খবর পেয়ে। শ্রমিকরা বিভিন্ন এলাকার মোড়ে জমায়েত হয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে চাইলে তাদের লাঠিপেটা করে শায়েস্তা করা হয়। পুলিশ, আর্মির কড়া প্রহরা ঠেলে কেউই থামাতে পারেনি সেই সিদ্ধান্ত।

এরপরে পুরো জায়গা জুড়ে ক্রমে নিরাপত্তা বেষ্টনী কঠোর হয়েছে, যাতে কেউ আর ভবনের ধ্বংসস্তূপে ঢুকতে না পারে। ধীরে ধীরে নিরাপত্তা বেষ্টনী আগের চেয়ে বেশি দুর্বল হয়েছে। পথশিশু, উদ্ধারকর্মী, শ্রমিক পরিবারের সদস্যসহ অনেকেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করেছে হাড়-কঙ্কাল-খুলি। কিছুদিন যেতেই, প্রতিদিন রাত গভীর থেকে ভোর অব্দি, এমনকি দিনের বেলায়ও; পুলিশের লোক দেখানো বাঁশির শব্দ শোনার আগ পর্যন্ত, ওই জায়গায় রড-সিমেন্ট, লোহা লক্কড়ের মাল-মসলা কাপড়ের সাথে লোপাট হয়েছে নানা আলামত।

সাধারণ মানুষ, স্বজন, উদ্ধারকর্মীরা ওই শ্মশানে উদ্ধারকাজ চালানোর চেষ্টা চালালেও বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু ‘কে বা কারা’ কোনো বাধা পায়নি। দফায় দফায় হাড়-কঙ্কাল বেরুলেও আনুষ্ঠানিকভাবে আর উদ্ধার কাজ হয়নি। আর কত! সরকার, পুলিশ প্রশাসন, বিজিএমইএ, সেনাবাহিনী সবাই ক্লান্ত। কত, আর কত হাড্ডি, কত লাশ, কত দায়! ওগুলো মানুষের নয়, গরুর হাড্ডি বলে তাই দায় এড়ানোর চেষ্টা চালায় পুলিশ।

প্রাণে মারা গেছে সরকারি ঘোষণা মতে ১১৩৬। কিন্তু নিহত, নিখোঁজ আর ডিএনএর হিসাব কষে আমরা দেখেছি প্রায় ১১৭৫-এর বেশি শ্রমিক মারা গেছেন এই ধসে। অদ্ভুত যে এত মানুষ নাই হয়ে যাওয়ার পরও আজ পর্যন্ত রানা প্লাজার পাঁচটি কারখানায় মোট ক’জন শ্রমিক কাজ করতেন, ক’জন নিহত, ক’জন নিখোঁজ তার কোনো প্রকৃত হিসাব মেলেনি।

শ্রমিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন, অন্যান্য সংস্থা তাদের উদ্যোগে যেসব নিখোঁজ তালিকা তৈরি করেছে সেইসবের কোনো সমন্বয় হয়নি। সরকার-বিজিএমইএ-এর প্রকৃত তালিকা তৈরির অনীহা দেখে মনে হয় তারা বলতে চাইছে—‘ওদের নাম-পরিচয়-এতসব তথ্য-তালাশের কী আছে? ওরা তো এমপি, মন্ত্রী, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, আমলা কেউই না; ওরা প্রাণ নয় সংখ্যা, ওরা শ্রমিক, টাকা তৈরির নাটবল্টু। ওদের পরিচয় তালিকা নিয়ে ভাববার সময় কই সরকার-মালিক আর বিদেশি ক্রেতাদের।’ স্পেকট্রাম থেকে রানা প্লাজা এত বছরের ঘটনাগুলোয় পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি, বিশেষভাবে নিখোঁজদের তালিকা।

কারখানা ইতিহাসের এই নিষ্ঠুরতম ঘটনার শিকার মানুষগুলোর জীবন সরকার-মালিক-বিদেশি বায়ারদের কাছে অগুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশের নাগরিকদের কাছে কি তাই? রানা প্লাজার শ্রমিকরা তো এদেশেরই নাগরিক।

দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এরাই তো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ‘নাই’ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আমাদের কি থাকে?

 

 

Share this post

PinIt
scroll to top