দেশের তথ্য ডেস্ক।। পরনে বিশেষ পোশাক। মুখে কালি মাখা। হাতে অস্ত্র। কারও কারও মাথায় টুপি। কাঁধে ব্যাগ। পায়ে বুট জুতা। এভাবে সজ্জিত হয়ে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করতে এসেছিল অস্ত্রধারীরা। ব্যাংকগুলোর সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে এই চিত্র পাওয়া গেছে। সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে ওই ফুটেজ এবং ফুটেজ থেকে নেওয়া বেশ কিছু ছবি পাওয়া গেছে।
বান্দরবান শহর থেকে রুমার দূরত্ব প্রায় ৪২ কিলোমিটার। রুমা উপজেলা পরিষদের ২০০ গজ দূরে সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখা। তার পাশে উপজেলা মসজিদ। আশপাশে সব উঁচু উঁচু পাহাড়। ব্যাংক ভবনের প্রতিটি মেঝেতে দুটি করে ইউনিট রয়েছে। নিচতলার দুটি ইউনিটে থাকেন উপজেলা পরিষদের সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। আর ওপরে দোতলায় একটি ইউনিটে সোনালী ব্যাংকের শাখা। আরেকটিতে ব্যাংকটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ১০ সদস্য থাকেন।
২ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রথমে রুমার এই ব্যাংকে হানা দেয় অস্ত্রধারীরা। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবিতে দেখা যায়, ডাকাতির সময় সিঁড়ি বেয়ে সশস্ত্র কেউ দোতলায় উঠছে। আর কেউ সতর্ক পাহারায় রয়েছে। আর কেউ কেউ ব্যাংকের ভেতরে কর্মকর্তাদের টেবিলের সামনে অবস্থান করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কেএনএফ সদস্যরা হামলার আগে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। এতে উপজেলা পরিষদ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। অস্ত্রধারীরা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে বান্দরবান-রুমা সড়কে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়।
হামলায় নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) শতাধিক সদস্য অংশ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগের পরনে ইউনিফর্ম (নির্দিষ্ট পোশাক) ছিল। সদস্যরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে সোনালী ব্যাংক, স্থানীয় মসজিদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনের দিকে যায়। ইউএনওর বাসভবনের দিকে তারা আনসার সদস্যদের অস্ত্র কেড়ে নেয়। মসজিদে তখন নামাজ চলছিল। সেখানে ২০ জনের মতো মুসল্লি ছিলেন জানিয়ে রুমা উপজেলা মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম বলেন, ২০ থেকে ২৫ জন অস্ত্রধারী মসজিদে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে তারা সোনালী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে ধরে নিয়ে যায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কনস্টেবল রূপন শীল বলেন, ‘আমি আর কনস্টেবল তৌহিদ ব্যাংকের সামনে পাহারায় ছিলাম। হঠাৎ দেখি ইউনিফর্ম পরা অস্ত্রধারী কয়েকজন। তারা আমাদের ব্যারাকে ঢুকিয়ে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে থাকা অস্ত্র ও মুঠোফোন নিয়ে নেয়।’
অস্ত্রধারীরা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫টি গুলি লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার পরদিন বিকেলে সিআইডি জানায়, রুমায় সোনালী ব্যাংকের ভল্টে থাকা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা পুরোটা রয়েছে। তবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে অস্ত্রধারীরা নিয়ে গেছে। এর ৪৮ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার ব্যবস্থাপককে রুমা সদরে ছেড়ে দেয় অস্ত্রধারীরা। সেখান থেকে র্যাব তাঁকে উদ্ধার করে।
রুমায় হামলার পরদিন ৩ এপ্রিল থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হানা দিয়ে ১৭ লাখের বেশি টাকা নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। বান্দরবান থেকে সড়কপথে থানচির দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। সেখানে সাপ্তাহিক হাটবার ছিল ৩ এপ্রিল (বুধবার)। সকালে বাজারে লোকজন বেশি ছিলেন। দুপুর হতে হতে ভিড় কমে যায়। হামলা হয় বেলা একটার দিকে। সেখানে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের শাখা দুটির অবস্থান পাশাপাশি। কাছেই থানচি থানা। উপজেলা পরিষদও বাজারের কাছে।
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, অস্ত্রধারীরা আসে দুটি চার চাকার মোটরগাড়িতে, যা স্থানীয়ভাবে ‘চাঁদের গাড়ি’ নামে পরিচিত। সংখ্যায় ছিল ৪০ জনের মতো। ব্যাংকের ভেতরে আট–১০ জন ঢুকলেও বাকিরা বাজারের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। এ সময় তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে।
অস্ত্রধারীরা থানচি কৃষি ব্যাংকের শাখার নিরাপত্তা প্রহরী অং সা প্রুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। চার থেকে পাঁচজন অস্ত্রধারী ব্যাংকে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। বাইরে আরও সাত–আটজন অবস্থান করছিল। অল্প সময়ের মধ্যে অস্ত্রধারীরা ব্যাংকের টাকা লুট করে বেরিয়ে যায়। গ্রাহকদের মুঠোফোনও কেড়ে নেয় তারা।
আর সোনালী ব্যাংকের থানচি শাখায় ঢোকে সাতজন অস্ত্রধারী। ক্যাশ কাউন্টারে থাকা টাকা তারা নিয়ে যায়। ব্যাংকের বাইরেও ১০ থেকে ১২ জন অস্ত্রধারী ছিল। পরে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে যায়। অস্ত্রধারীরা দুটি ব্যাংকের শাখা থেকে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
এসব ফুটেজের বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হোসাইন মোহাম্মদ রায়হান কাজেমী বলেন, ব্যাংক লুটের চেষ্টার ঘটনায় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ইতিমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনাক্ত করে বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, অস্ত্র ও টাকা উদ্ধারে বান্দরবানে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বিত অভিযান চলছে। অভিযান সমন্বয় করছে সেনাবাহিনী। রোববার শুরু হওয়া এ অভিযানে কেএনএফের দুই সদস্যসহ ৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনায় রুমা ও থানচি থানায় ছয়টি মামলা হয়েছে।