রমজানে সিয়াম সাধনা ও তাকওয়া অর্জন

ramadan.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক।। পবিত্র কোরানে সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেনঃ ’ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুম।’ অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, রোজা তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর ফরজ করা হয়েছিলো যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ এই আয়াতে স্পষ্ট যে প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য রোজা ফরজ। দ্বিতীয়তঃ এ যাবত দুনিয়ায় যতো শরীয়ত নাজিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়ত পালনকারীদের জন্য আল্লাহ রোজা ফরজ করেছিলেন। সুতরাং রোজার প্রয়োজনীয়তা আল্লাহ নিজেই অনুধাবন করে যুগে যুগে এ এবাদতকে ফরজ করেছেন। আল্লাহ নিশ্চই বড় সমজদার, মহৎ পরিকল্পনাবিদ ও প্রজ্ঞাময়।

ফরজ ইবাদতগুলোর মধ্যে রমজানকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামের প্রতীক হিসেবে ধরা যায়। কেননা রমজানে রোজার সাথে মহান আল্লাহ, প্রিয় নবী (দঃ), কদরের রাত, আল-কোরান ও তাকওয়া অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যে বান্দা প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া অর্জন করলো সে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত হলো। সুরা নহলের ১২৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ ’ইন্নালল্লাহা মায়াল্লাজি নাত্তাকাও।’ অর্থাৎ নিশ্চই আল্লাহ তাদের সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। দ্বিতীয়তঃ পবিত্র হাদিস অনুযায়ী রমজানের প্রথম ১০ দিন রহমতের জন্য, মাঝের ১০ দিন মাগফেরাতের জন্য এবং শেষ ১০ দিন নাজাতের জন্য। তাহলে দেখা যায় এ মাসে আল্লাহর রহমত পাওয়া যাচ্ছে, পাপের জন্য ক্ষমা পাওয়া যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত নাজাত বা মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। তৃতীয়তঃ এ মাসে কদরের রাত রয়েছে যা হাজার মাস হতে উত্তম। ঐ রাতে ইবাদতের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। চতুর্থতঃ সংযম, আল্লাহ ভীতি ও আনুগত্যের জন্য তাকওয়া অর্জিত হচ্ছে এবং সবশেষে আল্লাহ বলেন: ‘রোজা আমারই এবং এর প্রতিদান আমিই দেব।’ ইসলামে অন্য সকল ইবাদতের বিষয়টি অর্থাৎ তার সৎ কর্মের ফল কি হবে তা ইবাদতকারীর নিজের ওপর বর্তায়। শুধুমাত্র রমজান মাসে সকল সৎ কর্মের প্রতিফল আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ তিনি নিজেই বান্দার দায়িত্ব নিয়েছেন। শুধু তাই নয় এ মাস আনন্দের মাস, ঈদের মাস। তাই রমজান মাসের ফজিলত অপরিসীম।

সুরা ইউনুস ৬৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ ’আল্লাজিনা আমানু অকানু ইয়াত্তাকুন।’ অর্থাৎ যে ব্যাক্তি তাকওয়া অর্জন করেছে তার জন্য দুনিয়ায় ও আখেরাতে সুসংবাদ রয়েছে। সে জন্য আল্লাহ প্রত্যেক নবীর উম্মতের মধ্যে তাকওয়া তথা পরহেজগারীর গুণ সৃষ্টি করে বান্দাকে মুত্তাকী বানানোর জন্য রোজা ফরজ করেছেন। সত্যিই আল্লাহ তার সৃষ্টি বান্দার জন্য দয়াশীল ও প্রেমময়। এখন ’তাকওয়া’ বলতে আমরা কি বুঝি? প্রকৃতপক্ষে তাকওয়ার অর্থ অনেক ব্যাপক। ’তাকওয়া’ এর মূল অর্থ খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা। পবিত্র কোরানে তাকওয়া শব্দটি ৩টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেঃ ১ম অর্থ আল্লাহ ভীতি, ২য় অর্থ আনুগত্য ও ৩য় অর্থ গোনাহ (খারাপ পাপ কাজ) বর্জন। অর্থাৎ তাকওয়া অর্জনের জন্য অন্তরে আল্লাহর ভয় রেখে তার ওপর পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে সংযম অবলম্বন করে খারাপ কাজ ও পাপ বর্জন করতে হবে। এই তিনটি অর্থের দিকে মোটামুটি লক্ষ্য রেখে রোজা পালন করতে হবে। হাদিস শরীফে আছে ’আসসিয়ামু জিন্নাতুন’- অর্থাৎ রোজা ঢালস্বরূপ।

রোজা সমস্ত কুকর্ম ও গোনাহের জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এখন দেখা যাক তাকওয়ার সাথে রোজাদারের কি সম্পর্ক? তাকওয়া শব্দের সাথে মুক্তাকী শব্দ জড়িত। মুক্তাকী ’ওয়াকি’ ধাতু হতে উৎপত্তি এর অর্থ কষ্টদায়ক বা ভীতিপ্রদ বস্তু হতে আত্মরক্ষা করা বা সাবধানতা অবলম্বন করা। অন্য অর্থে কণ্টকাকীর্ণ পথ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে বিশেষ সতর্কতার সাথে দ্রুত পার হওয়া। মূলতঃ আমাদের অনেকগুলো আত্মিক রোগ রয়েছে, যে রোগগুলো নফসের সাথে সম্পৃক্ত। ঐ সমস্ত রোগগুলো সৎ সত্য পথে চলার কাঁটা বা অন্তরায়। তাই তাকওয়ার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করে চলা একান্ত দরকার। সে জন্য অন্য সময়ে যে খাদ্যদ্রব্য ও কর্মটি হালাল, তা আল্লাহ রমজানে হারাম করেছেন। নফস বড়ই বেয়াড়া, তার নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন, তার ওপরে রয়েছে মানব অন্তরে শয়তানের অসওয়াসা। তাই নফসকে সংযত, সংহত করার জন্য রোজা পালন করা হয়, অপর পক্ষে আল্লাহ মেহেরবান হয়ে এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করেন। তাই নফসের বশবতী হয়ে পাপ কাজ না করার অনুশীলনের মাধ্যমে নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য সিয়াম সাধনা করতে হবে।

নামাজ প্রতিদিনের, সিয়াম কিছুদিনের, তাই নামাজ কায়েম করতে হবে এবং সিয়াম পালন বা সাধনা করতে হবে। তাকওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় রয়েছে তা হলো সন্দেহ ও হারাম বর্জন করতে হবে। তাকওয়া আত্মিক প্রতিষেধক বা ঔষধ যা অন্তরের রোগকে নির্মূল করে বান্দাকে মুত্তাকী বা পরহেজগার বানায়। তাকওয়া একটি শক্তিশালী কৌশল যার শিখায় অন্তরে জেগে ওঠা কুকাজ ও কুচিন্তা পুড়ে আত্তা পবিত্র ও খাক হয়। ফলে নৈতিক উন্নতি হয়। মানুষ শান্তি পায়। এছাড়া তাকওয়া অত্মনিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে। যার ফলে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, বদমেজাজ, গীবত, অপবাদ, অহংকার, রিয়া, হিংসা, সংসারের মায়া, সুদ, ঘুষ, পরশ্রীকাতরতা, অপচয়, হত্যা, ধর্ষণ, দূর্নীতি, অকৃতজ্ঞতা, ধোকা দেওয়া, মিথ্যা, কৃপণতা ((আত্মিক রোগসমূহ) ইত্যাদি কু-প্রবৃত্তির লালন বন্ধ হয়।

মাওলানা রুমী বলেনঃ ’মানুষের শক্তি পাথর পাহাড় ভাংতে পারে, আত্মিক শক্তি চন্দ্র দু’ভাগ করতে পারে (নবী করিম (দঃ) এর অঙ্গুলীর নির্দেশে চন্দ্র দু’ভাগ হয়েছিল)। তাই তাকওয়া অন্তরে বিশুদ্ধতা আনায়ন করে, ফলে দৈহিক, আত্মিক, মানসিক, নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে মানুষের আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই হাদিসে আছে : আল্লাহ সুগন্ধির চেয়ে রোজাদারের মুখের গন্ধ পছন্দ করেন।

ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেনঃ রোজা ঈমানের চার ভাগের এক ভাগ। তিনি আরও বলেনঃ রোজার তিনটি দিক রয়েছে যথা উপবাস পালন, দ্বিতীয়তঃ ইন্দ্রিয়গুলোকে পাপ হতে দূরে রাখা এবং তৃতীয়তঃ সবকিছু ফেলে অন্তরকে আল্লাহর দিকে রুজু করা। মানুষের তিন প্রকার গুণ রয়েছে: পশুবত, ফেরেশতাদের গুণ আর ঐশ্বরিক গুণ। রোজা পশুবত গুণকে ধ্বংস করে ফেরেশতা ও ঐশ্বরিকগুণকে উজ্জীবিত করে। পশুবত অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ নফসকে দমন করা ও সংযম প্রদর্শন করা। ফেরেশতাদের ও আল্লাহর কোন কিছু খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাই রোজা পালনের মাধ্যমে ঐশ্বরিক গুণ অর্জিত হয়। রমজানে মানব ইন্দিয়গুলোকে আত্মনিয়ন্ত্রণে রাখা উচিৎ। যতো প্রকার হারাম, অশ্লীল ও নিষিদ্ধ জিনিস, কথা, দৃশ্য ও বিষয়-এ সব কিছু হতে যথাক্রমে হাত, পা, ঠোঁট, চোখ ও কানকে দূরে রাখা-এর ফলে অঙ্গ-প্রতঙ্গের সিয়াম পালন হলো। কেহ ঝগড়া করতে এলে এটুকু বলতে হবে, ’আমি রোজা আছি।’ সুতরাং রোজা আত্মরক্ষামূলক ঢাল। এটা বুঝতে হবে যেখানে আল্লাহ হালাল জিনিসকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারাম তথা নিশিদ্ধ করেছেন, তাহলে এর ফজিলত কতো বড় কার্যকরী? এভাবে আত্মিক বিশুদ্ধতা সৃষ্টি হলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হবে এবং তখন রোজাদার মুক্তাকীতে পরিণত হবে। রোজা নফসে আম্মারা (পশুবত আত্মা-সুরা ইউসুফ: ৫৩ নং আয়াত ) হতে নফসে মুতমাইন্নায় (শান্তিময় আত্মা সুরা ফজর: ২৮ নং আয়াত) পৌঁছাইতে প্রশিক্ষণ দান করে।

ইমাম গায্যালী (রহঃ) রচিত এসলাহে নফ্স বা আত্মার পরিশুদ্ধি নামক পুস্তকে উল্লে¬খ আছে তাকওয়া অবলম্বনকারীগণ তিন প্রকারে মুত্তাকী হতে পারে। আর তা হচ্ছে শিরক, বিদআত ও ছোট ছোট পাপকর্ম বর্জন করে চলা। এখানে প্রথমতঃ শিরক হতে নিজেকে রক্ষা করে চলা অর্থাৎ আল্লাহর একত্তবাদে বিশ্বাসী হওয়া। দ্বিতীয়তঃ বিদআত হতে দূরে থাকা অর্থাৎ সুন্নাত আল জামায়াতের সঠিক অনুসারী হওয়া। তৃতীয়তঃ জেনেশুনে ছোট ছোট পাপ কাজ না করা। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলতেন তুমি মুত্তাকী হলে ইবাদতকারী হবে। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলতেন এক শস্য কণা পরিমান তাকওয়া বা আত্মশুদ্ধি অর্জন হাজার রাকায়াত নামাজ ও হাজারটি রোজা অপেক্ষা উত্তম। আল্লাহ যা কিছু নিষেধ করেছেন তার থেকে বিরত থাকাই মুত্তাকী হওয়ার আর একটি পথ। প্রতেকের রিজিকের উপর খুশি থাকাই উত্তম।

হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম বলেন, তাকওয়া দুই প্রকার, একটি হলো ফরজ, অপরটি ভয়। ফরজ তাকওয়া হচ্ছে গোনাহের কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। যে কাজ করলে নফসে আম্মারা আনন্দ অনুভব করে অর্থাৎ আত্মসংযম করে চলা উচিত। ভয় তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হারাম বস্তু বর্জন করা আর সন্দেহজনক কাজ হতে নিজেকে দূরে রাখা।

হযরত ইয়াহিয়া ইবনে মুআয (রঃ) বলেন, তাকওয়া দুই প্রকার যথা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কারুর জন্য কোন কিছু না করা প্রকাশ্য তাকওয়া, দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ ছাড়া অন্তরের মধ্যে অন্য কোন কিছুর অবস্থান না থাকা অপ্রকাশ্য তাকওয়া। তাই তাকওয়ার ব্যাপারে সুক্ষ্ম পন্থা অবলম্বন করা উত্তম।

আবু সুলাইমান দারানী (রহ.) বলেন, দুনিয়া বিমূখতা তাকওয়ার প্রথম কাজ। তাকওয়া অবলম্বনের অন্য একটি পন্থা হলো জবানকে নিরব রাখা। আল্লাহ পাকের জিকির, কোরান পাঠ, দরুদপাঠ, ধর্মীয় প্রয়েজনীয় কথাবার্তা ছাড়া চুপ থাকাই ভাল। যার অন্তর বাহির সমান সেই মুত্তাকী হতে পারে। নবী করিম (দঃ) বলেছেন, আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক রূপ চেহারা দেখেন না, তিনি দেখেন তোমাদের অন্তকরণ। অন্য এক হাদিসে এই অন্তকরণকে বলা হয়েছে বুকের বামপাশে একখ- মাংসের টুকরা রয়েছে সেটা যার ভাল সে ভাল, আর সেটা যার খারাপ সে খারাপ। অধিকন্তু তাকওয়া হিসাব নিকাশকে বিশুদ্ধ করে দেয়। অন্যের হক আদায় করাই তাকওয়া অবলম্বনের একটি বড় কাজ। তাই তাকওয়া একটি অন্তরের শক্তি যা মুনাফেকী ত্যাগ করে দ্বিধাহীন অন্তরে কাজ করে যায়।

 

 

 

Share this post

PinIt
scroll to top