দেশে গত আড়াই মাসে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনায় নারী-পুরুষ, শিশুসহ প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত দুই শতাধিক।
হঠাৎ কেন এত আগুন, নানা প্রশ্নযত্রতত্র বারবার আগুন লাগার পেছনে ২০টি কারণের কথা উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, মূলত অসচেতনতার জন্য এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী খতিয়ে দেখছে, ঘন ঘন এসব আগুন লাগার পেছনে কোথাও কোনো নাশকতার উদ্দেশ্য রয়েছে কি না।
সর্বশেষ গত রবিবার বিকেলে রাজধানীর বনানীতে টিঅ্যান্ডটি কলোনির গোডাউন বস্তিতে আগুন লেগে দুই শতাধিক ঘর পুড়েছে। বস্তি দখলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে এক বা একাধিক লোক এ আগুন লাগাতে পারে বলে সন্দেহ ক্ষতিগ্রস্তদের।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রাজিয়া বেগম নামের এক নারী বলেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতেও এই বস্তিতে রহস্যজনকভাবে আগুন লাগে। শুধু রাজিয়াই নন, বস্তিতে দুই শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি নাশকতা কি না, এই প্রশ্ন সামনে রেখে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনা তদন্ত করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গত রবিবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় টিকে গ্রুপের প্লাইবোর্ড তৈরির কারখানায় আগুন লাগে।
এ ঘটনা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গত শনিবার ভোরের দিকে নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়ার কাঁচাবাজারের সব দোকান আগুনে পুড়ে যায়।
এর আগে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে সাততলা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এই আগুনের প্রাথমিক তদন্তে বৈদ্যুতিক কেটলি থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে তথ্য পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে কী কারণ ছিল, তা এখনো জানা যায়নি। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এখনো তাদের প্রতিবেদন দেয়নি। তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ফরেনসিক আলামত সংগ্রহ করে তদন্ত চলছে।
পুলিশ জানায়, গত কয়েক মাসে শতাধিক ট্রেন, যানবাহন ও বহুতল মার্কেটের আগুনের বেশির ভাগ ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি উঠে এসেছে। পাশাপাশি নাশকতা আছে কি না, গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।
সম্প্রতি গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে টিনশেড ঘরে গ্যাসের লিকেজ থেকে লাগা আগুনে ৩৬ জন দগ্ধ হয়। এর মধ্যে ১৬ জন মারা গেছে। অন্যরা এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, চলতি বছর গত দুই মাসে সারা দেশে পাঁচ হাজার ৩৭২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে গড়ে প্রতিদিন আগুন লাগার ঘটনা ৮৯টি। গত ১৫ দিনে দেশে আরো পাঁচ শতাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
এত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারাও সংশয়ে আছেন, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না। গত বছর প্রতিদিন ৭২টি আগুনের ঘটনাও একই ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি করে। আগুনের ঘটনার মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে কম বরিশালে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা আগুন লাগার ২০টি কারণ উল্লেখ করে বলছেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ, গ্যাস ও মাটির চুলা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, উত্তপ্ত ছাই, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, শত্রুতামূলক ও উচ্ছৃঙ্খল জনতার অগ্নিসংযোগ, বজ্রপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজি পোড়ানো, মাত্রাতিরিক্ত তাপ, মেশিনের মিসফায়ার, স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বলন, স্থির বিদ্যুৎ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ, গ্যাস সরবরাহ লাইনে আগুন, যানবাহনে দুর্ঘটনাজনিত আগুন, খোলা বাতির ব্যবহার ও অজ্ঞাত রহস্যজনক আগুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসচেতনতাই মূলত অগ্নিকাণ্ডের কারণ।
আগুনের প্রতিটি ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রতিটি ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কমিটিগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তবে অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন আসতেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত আলোর মুখ দেখে না। আবার প্রতিবেদনে তদন্তের ফলাফল সামনে এলেও দুর্ঘটনার সব দায় শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি, ভবন ও কারখানা মালিকের ওপরই চাপানো হয়। সঠিক তদন্তের অভাবে ভুক্তভোগীরা বিচারও পায় না।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, সাধারণত বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা মনুষ্য সৃষ্ট কোনো কারণ থেকে আগুন লাগছে বেশি। এর বাইরে আগুনের ঘটনায় নাশকতা রয়েছে কি না, সেই সন্দেহ তৈরি হওয়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছি।
পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ঘন ঘন আগুনের প্রতিটি ঘটনা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। নাশকতার প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রতিটি আগুনের ঘটনায় নানা সন্দেহ থাকে। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত চলছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বাসাবাড়ি ও আবাসিক ভবনে সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটে। গত বছর বাসাবাড়িতে ছয় হাজার ৯৫৬টি আগুন লাগে, যা মোট আগুন লাগার ঘটনার ২৫.১৮ শতাংশ।
প্রতিবছরের শুরুর তিন মাসে আগুন বেশি লাগার তথ্য পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সূত্র বলছে, অতিরিক্ত গরম থাকা, দাহ্য পদার্থ মার্কেটগুলোতে গাদাগাদি করে রাখার ফলে এই তিন মাসে আগুন বেশি লাগে।
বছরের শুরুতে যত আগুন
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরে জানুয়ারিতে দুই হাজার ৩৭২টি এবং ফেব্রুয়ারিতে তিন হাজারটি আগুনের ঘটনা ঘটে। ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০২২ সালে আগুন লাগার ঘটনা ২৪ হাজার ১০২টি। ২০২১ সালে ছিল ২১ হাজার ৬০১টি।
আগুনের ঘটনা তদন্তের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এ ছাড়া ব্যাংক ও বীমা কম্পানিও দায়বদ্ধ। কিন্তু তদন্ত শেষে ভবন বা প্রকল্পের মালিক ছাড়া আর কাউকেই দায়ী করতে দেখা যায়নি। আবার গাফিলতির অভিযোগে দায়ী মালিককে শাস্তির আওতায় আনার নজিরও বিরল।
আগুনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁদের মৃত্যুতে এখন সংকটে গোটা পরিবার। এসব মৃত্যুর দায় নিচ্ছে না কেউ।
দেশের তথ্য ডেস্ক