ফেনীর ৩টি আসনের দুই-তৃতীয়াংশ এমপি প্রার্থীকেই চেনেন না ভোটারা

Feni.jpg

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনীর তিনটি আসনের দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীকেই চেনেন না ভোটাররা। স্থানীয়দের দাবি মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়া ২১ জনের মধ্যে ১৪ জনেরই রাজনীতিতে তেমন কোন পরিচিতি নেই।

মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) ফেনী-১ (ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া), ফেনী-২(সদর) ও ফেনী-৩ (দাগনভূঞা- সোনাগাজী) আসনের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাঁদের জোট সঙ্গী জাতীয় পাটি এবং জাসদ (ইনু)‍‍`র দল ব্যতিত অন্যান্য নামসর্বস্ব বিভিন্ন দল থেকে ফেনীর ৩টি আসনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের বেশিভাগেরই এলাকায় কোন প্রকার জনসম্পৃক্ত নেই। অনেকে নিজ এলাকায়ও থাকেন না। এজন্য নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষজন তাঁদের কাউকে চেনেনই না।

একেকটি আসনের বিভিন্ন পেশার ২০/২৫ জন ভোটারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়া জেলার ২১ প্রার্থীর মধ্যে ১৪ প্রার্থীর নাম তাঁরা নতুন শুনেছেন। এ ১৪ জনের কাউকেই ভোটাররা তেমন কেউই চেনেন না।

স্থানীয়দের দাবি, এসব প্রার্থীদের অনেককেই এর আগে রাজনীতির মাঠে দেখা যায়নি। অনেকের নামও শোনা যায়নি। তাঁদের দল কিংবা নেতা-কর্মীদের কোন কার্যক্রমও কখনই চোখে পড়েনি। তাদের অধিকাংশই স্থানীয় রাজনীতিতে অপরিচিতি মুখ। আওয়ামী লীগ ছাড়া শুধুমাত্র জাপার জেলা ও উপজেলা শহরে নামসর্বস্ব কমিটি থাকলেও জাসদের তাও নেই। তাঁদের নামসর্বস্ব একটি জেলা কমিটি ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের নিজ আসনে উপজেলা পর্যায়ে কমিটির খোঁজ পাওয়া গেছে।

তবে, ফেনী -৩ আসনে জাপা থেকে একাদশ এবং ফেনী-১ আসনে জাসদ থেকে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের দয়ায় এমপি নির্বাচিত হলেও দলীয় ভিত্তি না থাকায় টানা তিন মেয়াদের বর্তমান এ সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে জেলার কোথাও এ দুটি দলের একজন ইউপি সদস্যও নির্বচিত হয়নি।

এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়া অন্য বাকি দলগুলোর কারোরই জেলার কোথাও কোন কমিটি কিংবা অফিসের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ভোটারদের অনেকে বলছে তাঁরা এর আগে এসব দলের নামও শোনেননি। হঠাৎ করে এমপি নির্বাচনে আগ্রহী হলেন কেন? এমন প্রশ্ন করা হলে অনেক প্রার্থীর কাছ থেকেই সঠিক কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

এর মধ্যে ফেনী-১ (পরশুরাম- ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া) আসনে মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, জাসদ প্রার্থী শিরীন আখতার ছাড়া জাকের পার্টি প্রার্থী রহিম উল্যাহ ভূইয়া, বাংলাদেশ ইসলামীক ফ্রন্ট প্রার্থী কাজী মো. নুরুল আলম, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট প্রার্থী মাহবুব মোর্শেদ মজুমদার, তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী মো. শাহজাহান সাজুকে চেনেন না এক শতাংশ ভোটারও। নামও শোনেনি অনেকেই।

ফেনী-২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজাম উদ্দিন হাজারী ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী খন্দকার নজরুল ইসলামকে শহেরর কয়েকজন ভোটার চিনতে পারলেও তৃণমূল বিএনপির আমজাদ হোসেন সবুজ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের মো. নুরুল ইসলাম ভূইয়া, জাকের পার্টির নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামীক ফ্রন্টের মাওলানা নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ কংগ্রেস মোহাম্মদ হোসেন, খেলাফত আন্দোলন আবুল হোসেনের নামও শোনেনি অনেকেই।

ফেনী-৩ (দাগনভূঞা ও সোনাগাজী) আসনে জাতীয় পাটির লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের মো. আবুল বাশার, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক এমপি হাজী রহিম উল্যাহ ছাড়া বাকি বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি তবারক হোসেন, জাকের পার্টি আবুল হোসেন, ইসলামীক ফ্রন্ট বাংলাদেশ মো. আবু নাসির, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট নিজাম উদ্দিনের নামও শোনেনি অনেকেই। চেনেন না এক শতাংশ ভোটারও।

এর মধ্যে নৌকার তিন প্রার্থী নাসিম চৌধুরী, নিজাম হাজারী, আবুল বশর ছাড়া বর্তমান দুই সংসদ সদস্য জাসদের শিরীন আখতার ও জাতীয়পার্টির লে. জে. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর সর্বত্র পরিচিতি রয়েছে। তাছাড়া ২০১৪ সালে মহাজোট প্রার্থীকে হারিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা হাজী রহিম উল্যাহর সাথেও নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ রয়েছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ ছাড়া অন্যকোন সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন চোখে পড়েনি। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে প্রার্থী হন অনেকে। এমন একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সহ নানারকম আইনী জটিলতা থাকায় নির্বাচনে অংশ নিতে তারা নামস্বর্বস্ব নিবন্ধনপ্রাপ্ত একটি দলের মনোনয়ন নেন।

জেলার সচেতন মহলের দাবি, এসব দলের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে উল্লেখ করার মতো তৎপরতা চোখে পড়েনি। হঠাৎ করে নির্বাচনকে ঘিরে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট সহ বিভিন্ন দলের নাম শোনা যাচ্ছে।

ফেনী-২ আসনের তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আমজাদ হোসেন সবুজ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকায় অনেক নতুন ভোটার তাঁকে নাও চিনতে পারেন। তবে প্রবাসে থাকলেও এলাকার উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করছেন তিনি। বিজয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী এ প্রার্থী।

ফেনী-৩ আসনের জাকের পার্টির প্রার্থী আবুল হোসেন বলেন, এখনো প্রচারণা শুরু না করায় ভোটাররা তাঁকে হয়ত চেনেন না। প্রচারণায় নামলে অবশ্যই চিনতে পরবে।

ফেনী-১ আসনের নতুন ভোটার মীর হোসেন বলেন, ভোট দেয়ার ব্যপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। যাঁরা এমপি প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের নামও আমি কখনও শোনেনি।

ফেনী-২ আসনের ভোটার হাফিজ আল আসাদ বলেন, এবার আমাদের আসনে ১০ জন প্রার্থীর মধ্যে অনেককেই আমি চিনি না। শুধু আমি নয়, ফেনী শহরের বেশির ভাগ সাধারণ ভোটার তাঁদের নামও শোনেনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসেনি। ফলে নামসর্বস্ব এ সব দলের প্রার্থীর আবির্ভাব ঘটেছে। এবারের নির্বাচনে অপরিচিত কয়েকটি দল প্রার্থী দিয়েছে। যারা প্রার্থী হয়েছে, তাদের অধিকাংশই স্থানীয়দের নিকট অপরিচিত। এসব দল বা প্রার্থী ভোটের মাঠে কোনো সাড়া জাগাতে পারবে না।

অপরদিকে মনোনয়ন বাতিল হওয়া দুই প্রার্থীর এক শতাংশ ভোটারের ১০ জনের তথ্য যাছাইয়ে দেখা যায়, ইশতিয়াক আহমেদ সৈকতের জমাকৃত এক শতাংশ ভোটারের ১০ জনের মধ্যে একজন তার পক্ষে, ৬ জন বিপক্ষে বলেছেন, এক জন অনুপস্থিত ছিলেন, এক জনের কোন তথ্য অনলাইন করা নেই ও এক জনের নাম্বার সঠিক নয় ।

স্বতন্ত্র প্রার্থী পারভীন আক্তারের জমাকৃত এক শতাংশ ভোটারের ১০ জনের তথ্য যাছাই করে তিনজন তার পক্ষে, ৬ জন বিপক্ষে পাওয়া গেছে। একজনের তথ্য অনলাইনে নেই । যার কারণে তাদের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করেছেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, ফেনীর ৩টি আসনে ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ২১ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ ও ১৭ জনের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করেছেন রিটানিং কর্মকর্তা।

Share this post

PinIt
scroll to top