দেশের তথ্য ডেস্ক:-
সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানপ্রধানই যখন সরাসরি অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ হওয়া সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান।
কিন্তু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম একটি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন-বিআরটিসি; যেখানে চেয়ারম্যানই খোদ জড়িয়ে পড়েছেন অনিয়ম-দুর্নীতিতে। সংস্থাটির ছোট বড় প্রায় সব খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিতেই নিজেকে এমনভাবে জড়িয়েছেন চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম; যেন তিনি চেটেপুটে গিলছেন বিআরটিসিকে। নিয়োগবাণিজ্য থেকে শুরু করে স্বজনপ্রীতি, পারিবারিক সংশ্লিষ্টতা থেকে নারীপ্রীতি। হেন কোনো অভিযোগ নেই যার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। আর এসবের আংশিক ফিরিস্তি তুলে ধরে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগ সূত্রেই জানা যায়, তার অনিয়ম-দুর্নীতির এসব তথ্য।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বিআরটিসিতে বিগত আড়াই বছরে অবৈধভাবে প্রায় এক হাজার ২০০ লোককে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। যার বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে আট কোটি টাকারও বেশি ঘুষ গ্রহণ করেছেন। বিগত ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিআরটিসি থেকে তিনি অর্ধশত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো রাঁ (শব্দ) হয়নি কোথাও। প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে সাধারণত মুখও খুলতে চান না অধঃস্তনরা। এদিকে ঘুষের বিনিময়ে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে নুসরাত জাহান ও ইসরাত নামে দু’জনের নিয়োগই সংস্থাটিতে বেশ আলোচিত। কারণ তাদের দুজনকেই এ পর্যন্ত একাধিক পদে একাধিকবার নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। তাদের দুজনই প্রথম নিয়োগ পান কন্ট্রাক্টর ডি হিসেবে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফের তাদের নিয়োগ দেয়া হয় জব সহকারী হিসেবে। বর্তমানে আবারো তাদের একজনকে সহকারী নেজারত কর্মকর্তা ও আরেকজনকে কল্যাণ কর্মকর্তা পদে তৃতীয় দফায় নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তৃতীয় দফায় তাদের চাকরি দিতে চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের যে চেষ্টা তার প্রমাণ মেলে গত জুলাই মাসেও— তাদের দুজনেরই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়। বিআরটিসি সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নুসরাত জাহান ও ইসরাতের সাথে পৃথকভাবে চেয়ারম্যানের রহস্যময় সম্পর্ক রয়েছে। তবে সম্পর্কের গভীরতার বিষয়টি অনেকেই জানলেও সংস্থার অভ্যন্তরীণ চাপে পড়ার ভয়ে কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না।
এ ছাড়াও গত মে মাসে অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার পদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও পঞ্চম স্থান প্রাপ্ত হয়েছেন চাকরিপ্রার্থী মো. রাশেদ খান। পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষার সময় অসদুপায় অবলম্বনের জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের হাতে অটকও হন তিনি। ঘটনা জানাজানি হলে পরিচয় মেলে রাশেদের। তিনি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের ভাগ্নি জামাই। যে কারণে আটকের পর আর তাকে পুলিশে দেননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা; বরং তাকে ছেড়েই দেয়া হয়। গত আগস্টে বিআরটিসির নিরাপত্তা সহকারী পদে ফের তার নামে লিখিত পরীক্ষার কার্ড ইস্যু করা হয়।
বিগত ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিআরটিসির প্রধান কার্যালয়সহ সমস্ত ডিপোতে টেন্ডারবিহীন ও টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ করানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চেয়ারম্যান তার নিজস্ব লোকবল দিয়েই ডিপোর প্রায় প্রত্যেকটি কাজ করান। উৎকোচের মাধ্যমে মেসার্স আল মালিক ট্রেডার্স, এম এইচ এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স অনন্যা ট্রেডার্সকে দিয়েও কাজ করান তিনি। এ ক্ষেত্রে অন্য কারো কাজ পাওয়ার সুযোগ থাকে না। এসব কাজের মাধ্যমে এ যাবৎকালে তিনি ১২ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও তার ছেলে অমির ফাস্ট সিকিউরিটি ও স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মো. নজরুল ও জামান নামের জনৈক দুই ঠিকাদার ঘুষের অর্থ লেনদেন করেন। বিআরটিসির বাসে ইন্টারনেট স্থাপনের কাজটিও করেন চেয়ারম্যানের ছেলে অমি ও তার বন্ধু। তাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইন্টারনেট স্থাপনের কাজটি করা হলেও এর কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না যাত্রীরা; বরং প্রতি মাসেই দেশের সমস্ত ডিপো থেকে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অমি ও তার বন্ধু মাসিক প্রায় ১৮ লাখ টাকা বিল গ্রহণ করছেন।
এর মাধ্যমে গত দুই বছরে তিন কোটি টাকা হাতিয়েছেন তারা। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলামের আগের চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার সময় বিআরটিসির ফান্ডে ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা রেখে যান। তাও এখন নেমে এসেছে ১৪ কোটি টাকায়। শুধু তাই নয়, গাড়ির লিজ গ্রহীতাদের কাছ থেকেও গত দুই বছরে প্রায় চার কোটি টাকার উপঢৌকন গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। সমস্ত ডিপো ইনচার্জদের কাছ থেকে গাড়ি মেরামত, গাড়ির পার্টস ও যন্ত্রাংশ ক্রয় বাবদ ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমেও প্রায় আট কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন তিনি।
গত রোববার তার বিরুদ্ধের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তার (বিআরটিসির) পরিচালক প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। যদিও সার্বিক অভিযোগই তার বিরুদ্ধে, পরিচালক প্রশাসক কীভাবে কথা বলবেন জানালেও তিনি তার সঙ্গেই কথা বলতে বলেন। তিনি বলেন, বিআরটিসিতে এসে খবর নিয়ে যান ২০২১ সাল থেকে কী হয়েছে এখানে। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে দুদক তদন্ত করবে। এসবকে তিনি ভয় করেন না এবং এসব মোকাবিলার জন্যও তার বুকের পাটা রয়েছে বলে জানান তিনি।