সোশ্যাল মিডিয়ায় যৌন ব্যবসার ফাঁদ, অ্যাসকর্ট সার্ভিস নামে চলে দেহ ব্যবসা

digi.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক:- 

বিভিন্ন পেজ-গ্রুপে চলে প্রচার কার্যক্রম
অ্যাসকর্ট সার্ভিস নামে চলে দেহ ব্যবসা
বৃদ্ধ থেকে শিশু সবাই বুঁদ সোশ্যাল মিডিয়ায়
বেশি প্রভাবিত হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা
আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে স্যোশাল মিডিয়াভিত্তিক বিভিন্ন চক্র নানা অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় যৌন ব্যবসার ফাঁদ। দেশে উচ্চ আদালতের আদেশে পর্নোসাইট বন্ধ হলেও সোশ্যাল মিডিয়ার দুর্বল নিয়ন্ত্রণে বেড়েছে দেহ ব্যবসার ভার্চুয়াল ফাঁদ অ্যাসকর্ট সার্ভিসের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ। এখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সক্রিয় হওয়া বা বিভিন্ন কার্যকরী ভূমিকা পালন করা বিষয়গুলোতে পিছিয়ে আছে প্রশাসন। এক শ্রেণির অসাধু চক্র মেতে উঠেছে অসামাজিক কার্যকলাপে।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নতুন একটি প্রক্রিয়া চালুর ক্ষেত্রে আইনগত ভিত্তি থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনগত ভিত্তি না থাকলেও থাকে চাহিদা। অ্যাসকর্ট সার্ভিস তার একটি। প্রকাশ্যে দেহ বিক্রি আইনগতভাবে বৈধ নয়। সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটেও বিধি-নিষেধ রয়েছে। যদিও নারী-পুরুষ সবারই চাহিদা রয়েছে। তবে অ্যাসকর্ট সার্ভিসের মধ্য দিয়ে যেভাবে চলছে এটি নৈতিকতাবর্জিত কার্যক্রম। আইন, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি-নিষেধ এ তিনটি শিষ্টাচারের কোনোটিই এটিকে সমর্থন করে না। সমাজে এসব চলতে থাকলে তরুণদের নৈতিক স্খলন ঘটবে।

ঢাকায় অনলাইন অ্যাসকর্ট সার্ভিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লিভ ইন টুগেদার, ঢাকা রিয়েল সার্ভিস জোন, ঢাকা রিয়েল সার্ভিস অ্যান্ড গেস্ট হাউস, সিকরেট রিয়ের সার্ভিস ইন বিডি, ঢাকা অ্যাসকর্ট সার্ভিস, ভিআইপি মডেল সার্ভিস বিডি, ইমু সার্ভিস বিডি, ঢাকা অ্যাসকর্ট সার্ভিস, মেল অ্যাসকর্ট সার্ভিস ঢাকাসহ হাজারো পেজ ও গ্রুপ। এরকম কয়েকটি গ্রুপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাতের গভীরতা বাড়লেই এসব গ্রুপের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। অনেক সময় বিভিন্ন মেয়ের আইডি থেকে উত্তেজক ছবি পোস্ট করে ফোন নম্বর দিয়ে দেয়া হয়।

ফেসবুক অ্যাপে প্রবেশ করলেই চোখ আটকাবে ভিডিও, ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে। মারাত্মক নেশার মতো ফেসবুক ও রিল ভিডিও। অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ভিডিও সমাজের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষভাবে মেয়েদের অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ভিডিও। একটি শিশু স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই পিতা-মাতার স্মার্টফোন ব্যবহার করে অশ্লীল ভিডিও না বুঝেই দেখতে থাকে এবং বৃদ্ধরাও ইন্টারনেট সংযোগে স্মাটফোনের অপব্যবহার করে। সারা দিন পার করে এই ভিডিও দেখতে দেখতে।

ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি পেশায় একজন ফ্রিল্যান্সার তিনি জানান, আমার সন্তানের বয়স ছয় বছর পাঁচ মাস, সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে থাকে। জোর করে নিলে অস্বাভাবিক আচরণ করে। পরে কয়েকদিন ধরে খেয়াল করলাম ফেসবুকের ভিডিওতে আসক্ত। তার মধ্যে অশ্লীল আচরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে চলছে বিকৃত যৌনচর্চা। অনেক সময় গ্রুপ পাবলিক রেখে বা ক্লোজড করে দিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র যৌনাচার করছে। এসব গ্রুপে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মেয়ের নোঙরা-নগ্ন ছবি পোস্ট করা হয়। অনেক সময় গোপনে ধারণ করা ছবিও পোস্ট করা হয়। ফেসবুক পেজ কিংবা গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নারীদের সংগ্রহ করে তাদের ছবি প্রদর্শনীর মাধ্যমে খদ্দের সংগ্রহ করছে সার্ভিস প্রোভাইডাররা।

সপ্তাহের ২৪ ঘণ্টাই অনলাইনে সক্রিয় থাকে এসব চক্র। ফোন কিংবা মেসেজ করলেই সাড়া মিলছে। এসব পেজে শুরুতেই টেলিগ্রামের মাধ্যমে ফি দিয়ে মেম্বারশিপ নিতে হয়। এরপরই ক্যাটাগরি অনুযায়ী নারী দেখে নির্বাচন করা হয়। সমাজে কানায় কানায় অশ্লীল ভিডিওর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে, পরকীয়া, দেহব্যবসা, মাদকাসক্ত এমনকি খুনের মতো দুর্ঘটনাও সংঘঠিত হয়। দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী চার কোটি ৬৫ লাখ। বর্তমান দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৭ লাখ। মেটার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।

ইমুতেও রয়েছে অসংখ্য ভয়েস ক্লাব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিঙ্গেল ছেলে চাই প্রেম করব, বিয়ে করব স্বামী চাই, ছোট বাবুরা দূরে থাকো, নাবিলা কল সার্ভিস, মধু রানীর গল্প, শুভ রাত্রি, ক্রাশ খেয়েছি তোমার ওপর, সুন্দরীদের আড্ডা ঘর, ইমুতে নতুন আগুন, বৌদি প্রবাসী, সুমি সুমি গল্প। সম্মানের প্রশ্নে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দ্বারস্থ হচ্ছে না কেউই। পর্নোসাইট বন্ধে হাইকোর্টে রিট করা আইনজীবী ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘দেশে এ ধরনের কোনো কিছুরই আইনগত বৈধতা নেই। যেহেতু ডিজিটালি হচ্ছে সেহেতু এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসির)। আইনে তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থ পরিপন্থি কিছু হলেই তারা ব্যবস্থা নিতে পারবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও এ ধরনের পর্নোগ্রাফি ওয়েব কিংবা কনটেন্ট তৈরি করা বা এগুলো অফার করা শাস্তিমূলক অপরাধ। পেনাল কোডেও এ ধরনের অশ্লীল ছবি প্রকাশ, প্রচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।’

তিনি বলেন, বিষয়টি যেহেতু সমাজের সাধারণ মানুষকে বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে, সে ক্ষেত্রে জনস্বার্থ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মনিটরিং বাড়াতে হবে। এসব বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছাড়াও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় এটি বিজনেস ট্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু বিষয়ে আইনের সুস্পষ্ট বিধান নেই। কিন্তু ঐতিহ্য কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন রয়েছে। এসব অশ্লীলতা বন্ধে ও দেশের সার্বিক কল্যাণে মনিটরিং করা দরকার। কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও দেখে না। অথচ প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটছে এসব ঘটনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও অলিগলি-ফুটপাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখছে কার্ড। সেসব কার্ড কুড়িয়েই যোগাযোগ করে আবাসিক হোটেলে যাচ্ছে শিক্ষার্থী ছাড়াও তরুণ-তরুণীরা। এসব কাজে জড়াচ্ছে মধ্য বয়সি নারী-পুরুষও। কখনো কখনো প্রতারণাসহ খুনখারাবির ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ সময়ই সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে মাসোহারা দিয়েই চলছে এ কার্যক্রম। শুধু ঢাকায় নয়, এ কার্যক্রম ছড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও। জেলা পর্যায়ের আবাসিক হোটেল থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আটকের খবরও পুলিশ গণমাধ্যমে দিয়েছে একাধিকবার।

জানতে চাইলে বিটিআরসির পরিচালক (লিগ্যাল) তারেক হাসান সিদ্দিকী আমার সংবাদকে বলেন, ‘এসব বন্ধে বিটিআরসির অবশ্যই সুযোগ রয়েছে। আমাদের রেগুলেশন হাইকোর্ট থেকে চূড়ান্ত হলে আমরা গেজেটে আকারে করব।’ সুনির্দিষ্ট এমন কোনো লিংক থাকলে দেয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ক্ষতিকর কনটেন্ট দিয়ে কেউ যদি ওয়েব সাইট, গ্রুপ বা পেজ খোলে তাহলে আমাদের কাছে আবেদন করে জানাতে হবে। ভুক্তভোগীরা কোর্টে বা থানায় মামলা করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

পুলিশ সদর দপ্তরের উর্দ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ‘অ্যাসকর্ট সার্ভিসের মাধ্যমে এ ধরনের কাজ কোথায় হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে— নজরে আসা মাত্রই ব্যবস্থা নেবে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি যেকোনো কাজের বিরুদ্ধে সবসময়ই ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে পুলিশ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আমার সংবাদকে বলেন, ফেসবুক ইতিবাচক ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় যে নির্দেশনা আছে, বিটিআরসির যে নীতিমালা থাকা উচিত তাতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলেই প্ল্যাটফর্মকে পুঁজি করে অনৈতিক ব্যবসা বা কর্মকা্লের সাথে অনেককেই সম্পৃক্ত করে এখানে তারা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সক্রিয় হওয়া বা বিভিন্ন কার্যকরি ভূমিকা পালন করা বিষয়গুলোতে আমরা পিছিয়ে আছি। আমদের এ ব্যাপারগুলোতে বেশি সক্রিয় হতে পারি, রুচিগতভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেগুলো প্রয়োগ করা যায়; তাহলে এ অবস্থা থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ মিলবে।’

Share this post

PinIt
scroll to top