ফ্রান্স এদেশে স্যাটেলাইট কারখানা বানাতে চায় , প্রস্তাব নিয়ে আসছেন প্রেসিডেন্ট

france.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক:- 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। এ সফর ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। খতিয়ে দেখা হচ্ছে দুই দেশের সম্পর্কের আলোচনার নানা দিক। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট কারখানা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে ফ্রান্স। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানের ঢাকা সফরে সই হতে পারে একাধিক চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক।

সেপ্টেম্বরের ৯-১০ তারিখে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে আসবেন। ঢাকায় অবস্থানের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এর পাশাপাশি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন তিনি।

আগামী ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা ছাড়বেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। ৩৩ বছর আগে ১৯৯০ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।

গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হয়নি। অনেকেই জি২০ সম্মেলনে আসছেন। সেই সুযোগে তারা আমাদের দেশে আসার একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে প্রধানমন্ত্রী দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাঁর সফরের সূচি নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

সফরে আলোচনার বিষয় জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু, নারীর ক্ষমতায়ন, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোসহ আমাদের অনেক ইস্যু রয়েছে। সেই সঙ্গে অভিবাসন ও জলবায়ু বড় ইস্যু।

২০২১ সালের নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় সফরে ফ্রান্স গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় তিনি ইমানুয়েল মাখোঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্স সফরের সময় দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারের জন্য ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় জোর দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে প্যারিসের এলিসি প্রাসাদে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের পর দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্মতিপত্রে সই করে। সে সময় বাংলাদেশে স্যাটেলাইট কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব দেয় ফ্রান্স।

স্যাটেলাইট কারখানা তৈরির প্রস্তাবের বিষয়টি নিশ্চিত করে নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ফ্রান্স সফরে এ প্রস্তাবটি বাংলাদেশকে দেওয়া হয়। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ার কারণে এর অগ্রগতি হয়নি। তবে এ চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে ২০২৪ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরে আনার একটি পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এখন যেহেতু তাঁর বাংলাদেশ সফরের সুযোগ তৈরি হয়েছে; ফলে স্যাটেলাইট কারখারা স্থাপনের বিষয়টি আলোচনার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। এ নিয়ে হতে পারে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সফরটি মূলত প্রধানমন্ত্রীর প্যারিস সফরের ফিরতি সফর। সে সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্তের আলোকে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ঢাকায় আলোচনা হবে।

তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট তৈরির বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা সই হয়েছে। এটি একটি বড় স্যাটেলাইট। ফলে এখানে অনেক ‘ব্লাইন্ড স্পট’ থাকবে। এদিকে ফ্রান্সের প্রস্তাব ছোট চারটি স্যাটেলাইটের। ফলে ‘ব্লাইন্ড স্পট’ থাকার আশঙ্কা নেই।

কারখানা তৈরির প্রস্তাব বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব ও ঢাকায় ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের কাছে সমকালের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তবে কারও কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

যা রয়েছে প্রস্তাবে
বাংলাদেশকে চারটি ছোট পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট কেনার প্রস্তাব দিয়েছে ফ্রান্স। এ স্যাটেলাইটগুলো তৈরি করবে এয়ারবাস প্রতিষ্ঠান। চুক্তি সইয়ের প্রথম দিন থেকে কন্সটেলেশন সেবা যুক্ত থাকবে, যাতে একে অপরের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করতে পারবে উভয় দেশ।

চারটি স্যাটেলাইটের প্রথম দুটি স্যাটেলাইট তৈরি হবে ফ্রান্সে। এ দুটি তৈরির পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি স্যাটেলাইট সংযোজন কারখানা স্থাপন করবে এয়ারবাস। এর পর বাকি স্যাটেলাইট দুটি তৈরি হবে বাংলাদেশে। এতে পূর্ণ প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হবে। সেই সঙ্গে তৈরি হবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন কারখানা। চুক্তি সই থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ছয় বছর সময় ধরা হয়েছে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে সম্মতিপত্র সই করেছিল। তাতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো রয়েছে।

ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত প্রেক্ষাপট

স্যাটেলাইট নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত দিক বিবেচনায় তিনটি প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ নির্মাণ এবং উৎক্ষেপণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এর মধ্যে ফ্রান্সের প্রস্তাব অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মন্তব্য করছেন কূটনীতিকরা।

তারা জানান, প্রথমত এ প্রস্তাব বাংলাদেশ গ্রহণ করলে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের কী হবে– সেটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এত স্যাটেলাইট বাংলাদেশের প্রয়োজন নেই। আর স্যাটেলাইট রক্ষণাবেক্ষণের বেশ খরচ রয়েছে। এ বিলাসিতার এখনও সময় আসেনি স্বল্প-মধ্যম আয়ের এ দেশের।

দ্বিতীয়ত এয়ারবাস স্যাটেলাইট তৈরি করলে বাংলাদেশে তাদের অন্যান্য পণ্যের একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি হবে। এতে বাংলাদেশ বিমানের বহরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের পরিবর্তে একে একে যুক্ত হবে এয়ারবাসের উড়োজাহাজ। ফলে বাংলাদেশ থেকে বাজার হারাবে বোয়িং। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বাজার নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বিশ্বের জায়ান্ট দুই প্রতিষ্ঠানের। চলতি বছরের মে মাসে লন্ডনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে এয়ারবাসের ১০ উড়োজাহাজ বিক্রির বিষয়ে যৌথ ঘোষণা সই হয়, যা বিমানের পরিচালনা পর্ষদ প্রাথমিকভাবে সম্মতি দিয়েছে।

পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে লিখিতভাবে জানানো হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে এয়ারবাস থেকে আটটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ কিনবে বিমান। পরবর্তী সময়ে আলোচনা সাপেক্ষে আরও দুটি মালবাহী (কার্গো) উড়োজাহাজ কেনা হবে। এর পরই শুরু হয় বোয়িংয়ের দৌড়ঝাঁপ। তারা নতুন করে ড্রিমলাইনার বোয়িং ৭৮৭-৯ এবং ৭৮৭-১০ উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশের কাছে। বর্তমানে বিমানের বহরে ২১টি উড়োজাহাজের মধ্যে ১৬টি বোয়িংয়ের এবং ৫টি ড্যাশ-৮।

তৃতীয়ত, দুই দেশের মধ্যে যেহেতু কন্সটেলেশন সেবা থাকবে। ফলে দুই দেশই একে অপরের স্যাটেলাইট দিয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি করতে পারবে। ফ্রান্সের স্যাটেলাইট যদি ইউক্রেনের ওপর দিয়ে উড়তে থাকে, তাহলে সেই স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশ চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। একইভাবে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট যদি ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে ওড়ে, তা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে ফ্রান্স।

Share this post

PinIt
scroll to top