“ইসলামের সৈনিক” এর নামে চিরকুট প্রাপ্তি এর রহস্য উন্মোচন, খুনী সনাক্তকরণ ও মূল পরীকল্পনাকারী ইমনসহ ০৩ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

jongi-1.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক:- 

র‌্যাব-৬ ও র‌্যাব-১৩ এবং র‌্যাব-৪ এর যৌথ আভিযানিক দল ২১ আগস্ট ২০২৩ তারিখে রংপুরের মিঠাপুকুর, যশোরের চৌগাছা ও ঝিনাইদহ সদর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সাভারের চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস স্কুল শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া হত্যা কান্ডের রহস্য উদঘাটন পূর্বক হত্যা কান্ডের মূলহোতাসহ ০৩ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
গত ২০ আগস্ট ২০২৩ তারিখে ঢাকা জেলার সাভার মডেল থানাধীন রেডিও কলোনীর জামসিং রোডের নিজ বাসভবনের ভিকটিম এর কক্ষ হতে লুঙ্গী দিয়ে হাত-পা বাঁধা ও গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় সাবেক স্কুল শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া (৪৩) এর লাশ পাওয়া যায়। ভিকটিম প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলেও গত ২০ আগস্ট ২০২৩ তারিখে দুপুর পার হয়ে গেলেও তিনি তার রুম থেকে বের না হওয়ায় তার রুমের কাছে গিয়ে দরজা বন্ধ অবস্থায় দেখতে পায় তার প্রতিবেশিরা। পরবর্তীতে পেছনের দরজায় গিয়ে সেটি খোলা পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পায় যে, খাটের উপর লুঙ্গী দিয়ে হাত-পা বাঁধা ও গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় তার মরদেহ পরে আছে ও মরদেহের পাশে একটি চিরকুট পাওয়া যায় সেখানে লেখাছিলো, “এই ব্যক্তি সমকামী করে পুলিশ ভাই, আমরা তাই মেরে ফেলেছি। ভাই ও অবৈধ কাজ করে, আমরা ইসলামের সৈনিক।”ভিকটিম গোলাম কিবরিয়া একাই ঐ বাসায় থাকতেন, তিনি সাভারের রেডিও কলোনী মডেল স্কুল এর সাবেক শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি সাভারের বিভিন্ন স্থানে টিউশনি করতেন, পাশাপাশি জমি কেনা বেচার ব্যবসা করতেন। ভিকটিমের পায়ে সমস্যা থাকায় তিনি দীর্ঘক্ষণ হাটতে পারতেন না। গত ২০ আগস্ট ২০২৩ তারিখ সকালেও বের হয়নি। ভিকটিম নরমালি দুপুর ১২ টার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠতো। তবে গত ২০ আগস্ট ২০২৩ তারিখে দুপুর হয়ে গেলেও তিনি ঘুম থেকে না উঠায় প্রতিবেশীরা রুমে গিয়ে মরদেহ দেখতে পান। এসময় তারা রুমের ভেতরে থাকা একটি স্টিলের আলমারী তালা ভাঙা এবং ভেতরের মালামাল তছনছ অবস্থায় দেখতে পান ও সেখানে জমানো অনেক টাকা ছিলো বলে জানা যায়। বিষয়টি স্থানীয় জনসাধারণ র‌্যাবকে অবহিত করলে র‌্যাব-৪ এর একটি অভিযানিক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ও উক্ত হত্যার রহস্য উদঘাটন ও অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনতে তৎক্ষণাৎ গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৬ ও র‌্যাব-৪ এবং র‌্যাব-১৩ এর একটি যৌথ আভিযানিক দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গোলাম কিবরিয়া হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন পূর্বক হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত মূলহোতা ০৩ জন’কে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, ধৃত আসামী মোঃ সাগর (২৩) পেশায় একজন অটোরিক্সা চালক। বিগত ২০১৯ সালে রিক্সা চালনার সময় ভিকটিম গোলাম কিবরিয়ার সাথে পরিচয় হয় এবং পরিচয়ের একপযার্য়ে আসামী সাগর কে সাথে নিয়ে সাভার বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় ভিকটিমের নিজ বাসায় গমন করেন এবং ভিকটিমের মোবাইল নম্বর আসামী সাগর সংগ্রহ করে রাখে। পরবর্তীতে ভিকটিমের সাথে আসামী সাগর মোবাইলে নিয়মিত অডিও ও ভিডিও কলে কথা বলত। ভিডিও কলে কথা বলার এক পর্যায়ে ভিকটিম তার বাসার আলমারীর ভিতরে জমি কেনা বেচার বিপুল পরিমান টাকা পয়সার ছবিও দেখাতো। আসামী সাগর সেই টাকার লোভে ভিকটিমের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলে। সেই সুবাদে সে ভিকটিমের বাসায় আসা যাওয়া করত এবং সেই টাকা কিভাবে হাতিয়ে নেওয়া যায় তা পরিকল্পনা করতে থাকে। আসামী সাগরের বন্ধু ইমন খান (২৩) এর সাথে বিগত ০৬ মাস পূর্বে ভিকটিম একজন বিত্তবান ও অনেক টাকা পয়সার মালিকের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করে। তারা সেই বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক সাগর তার বন্ধু ইমনকে ভিকটিম গোলাম কিবরিয়ার মোবাইল নম্বরে কথা বলে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় ও তারও সাথে ভিকটিমের সু-সম্পর্ক সম্পর্ক গড়ে উঠে। ঘটনার ০৩ দিন পূর্বে ভিকটিমের সাথে ইমনের ভিডিও কলে কথা বলার এক পর্যায়ে জমি বেচা কেনা বাবদ বিপুল পরিমান টাকা ইমন দেখতে পায়। তখন ইমন তার আরেক বন্ধু ছাদেক এর সাথে ভিকটিমের বিপুল পরিমান টাকা পয়সার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করে। ঘটনার দিন গত ২০ আগস্ট ২০২৩ তারিখ রাত ০৮.০০ ঘটিকার সময় আসামী সাগর, ইমন ও ছাদেক সাভারের বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করে যে, আজ রাতে যে ভাবে হোক তাকে মেরে ফেলে তার কাছে থাকা টাকা পয়সাসহ অন্যান্য মুল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিবে। ঐ দিন রাতে পরিকল্পনার অনুযায়ী সাগর অটোরিক্সা নিয়ে ভিকটিমের বাসার আশ পাশ এলাকায় অবস্থান করবে এবং ইমন ও ছাদেক ভিকটিম গোলাম কিবরিয়ার বাসার প্রবেশ করবে। সেই মোতবেক ইমন ভিকটিমকে ফোন করে বলে যে, আমি ও আমার বন্ধু ছাদেককে নিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে আসতেছি। ভিকটিম তাদের কথা মতে সরল বিশ্বাসে রাতে আসতে বলে। আসামীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর অটোরিক্সা নিয়ে ভিকটিমের বাসায় আশপাশ এলাকায় অবস্থান করে এবং ইমন ও ছাদেক ভিকটিমের বাসার রাত অনুমান ১০.৪৫ ঘটিকার সময় প্রবেশ করে। ভিকটিম তার বাসায় একা থাকার সুবাদে ইমন, ছাদেকসহ রাতের হালকা নাস্তা করে ও কথা বার্তা বলতে থাকে। রাত অনুমান ১১.৩০ ঘটিকার সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে আসামী ছাদেক ভিকটিমের গলা চেপে ধরে ও আসামী ইমন মুখ চেপে ধরে তারা কৌশলে ভিকটিমের লুঙ্গী দিয়ে হাত-পা বেঁধে ও গলায় গামছা পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। আসামী ছাদেক একটি সাদা কাগজে চিরকুট লিখে, “এই ব্যক্তি সমকামী করে পুলিশ ভাই, আমরা তাই মেরে ফেলেছি। ভাই ও অবৈধ কাজ করে, আমরা ইসলামের সৈনিক।” যা মৃতদেহের পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। মৃত নিশ্চিত করার পর ভিকটিমের বিছানার নিচ হতে আলমারীর চাবি নিয়ে আলমারী থেকে ৬,৫০,০০০/- টাকা, ০৪টি মোবাইল ফোন, বিভিন্ন টাকার কয়েন, ০৪ প্যাকেট সিগারেট ও ০১ টি ক্যাচি নিয়ে ধৃত আসামী সাগরকে ফোন দেয়। তখন সাগর তার অটোরিক্সা নিয়ে ভিকটিমের বাসার সামনে আসে ও ইমন, ছাদেকসহ তারা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। সাগরের অটোরিক্সা করে সাভার বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় পৌছোনোর পর আসামী ইমন সাগরকে ৫০,০০০/- টাকার একটি বান্ডিল দেয়। অপর দুই আসামী ইমন ও ছাদেক উভয় ইমনের জিরানী বাসায় পৌছানোর পর বাকী টাকা সমান ভাগাভাগি করে নেয়। পরের দিন সকালে আসামীরা আত্মগোপনের উদ্দ্যেশ্যে সাগর রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকায় নিজ বাড়ী, ইমন যশোর চৌগাছা এলাকা নিজ বাড়ী ও ছাদেক ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নিজ বাড়ীর উদ্দ্যেশে চলে যায়। র‌্যাব-৪, র‌্যাব-৬ ও র‌্যাব-১৩ এর একটি যৌথ আভিযানিক দল আসামীদের নিজ নিজ এলাকা হতে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
আসামীদের জীবন বৃত্তান্তঃ
ক। সাগর (২২), রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকার শংকরপুর গ্রামের আব্দুল হাকিমের বড় ছেলে। সে পিতা-মাতাসহ বিগত ২০ বছর ধরে ঢাকার জিরানী ও সাভার এলাকায় বসবাস করে। সে পেশায় একজন অট্রো ড্রাইভার। তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও মাদক বেচা কেনার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে এলাকায় বিশৃঙ্খলা, মাদক ব্যবসা ও অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরার কারণে এলাকাবাসী তাকে ও তার পরিবারকে জিরানী এলাকা হতে বের করে দিলে সে পরিবারসহ সাভারে ওয়াবদা রোডে এসে বসবাস শুরু করে।
খ। ইমন খান (২৩), যশোর জেলার চৌগাছা থানার মাড়ুয়া গ্রামের আশরাফ হোসেন এর ছেলে। সে পিতা-মাতাসহ বিগত ১৫ বছর ধরে ঢাকার জিরানী এলাকায় বসবাস করে। সে আশুলিয়া এলাকার কাজী আব্দুল মান্নান কলেজ হতে এইচএসসি পাশ করে। সে আশুলিয়ার জিরানী এলাকার পিকিউসি গামেন্টস এ কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে কর্মরত আছেন। সে মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত। তার বিরুদ্ধে জিএমপি কাশিমপুর থানার মামলা নং-১৬, তারিখ-৩০ এপ্রিল ২০১৯, ধারা-৩৯৩ পেনাল কোড।
গ। মোঃ ছাদেক গাজী (২২) ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলায় কোলা গ্রামের ইনতাজ গাজীর বড় ছেলে। সে পিতা-মাতাসহ বিগত ২০ বছর ধরে ঢাকার জিরানী এলাকায় বসবাস করে। সে জিরানী বাজার মাসিহাতা গামেন্টস এর গামেন্টস কর্মী।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাভার মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেও এরূপ অপরাধীদের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৬ এর জোড়ালো সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।

Share this post

PinIt
scroll to top