দেশের তথ্য ডেস্ক রংপুর প্রতিনিধি :- পদ্মা সেতুর মতো তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার আশায় বুক বেঁধেছেন রংপুরের মানুষ। তিনি কাল রংপুর নগরীতে আসছেন। তার আগমনকে ঘিরে নগরীতে সাজ সাজ রব পড়েছে।
ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও পোস্টারে ভরে গেছে পুরো নগরী। বিভিন্ন স্থানে তোরণ স্থাপন করা হয়েছে। জিলা স্কুলের গোটা মাঠ সাদা কাপড়ে মোড়ানো হয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে মঞ্চ। ইতোমধ্যে জনসভাস্থলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টুনী।
রংপুর জেলা প্রশাসক মো. মোবাশ্বের হাসান জানিয়েছেন, বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রধানমন্ত্রী রংপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। দুপুর ২টায় তিনি হেলিকপ্টারযোগে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট হেলিপ্যাডে অবতরণ করবেন। সেখান থেকে সার্কিট হাউসে আসবেন। সেখানে বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
বিকাল ৩টায় রংপুর জিলা স্কুল মাঠে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা দেবেন। জনসভা শেষে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রংপুর ত্যাগ করবেন।
এদিকে, সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর রংপুরে আগমনকে স্বাগত জানিয়ে ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে শুভেচ্ছা মিছিল করেছে তিস্তা পাড়ের মানুষ। তাদের একটাই দাবি, রংপুর অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্যতা হ্রাস ও উন্নত জীবন যাপনের জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব কবির বিন আনোয়ার সংগ্রাম কমিটিকে জানিয়েছেন রংপুরের জনসভা থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলার ২ কোটি মানুষের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। আর তাদের নদী ভাঙনের কবলে পড়তে হবে না। এ অঞ্চলে থাকবে না কোনো বেকার, দারিদ্র্যতা। তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের।
অন্যদিকে, রংপুর নগরীতে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মহানগর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহফুজার রহমান বলেন, জনসভার মাঠটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নগরীতে ১০ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২৮ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। সেগুলো হচ্ছে- তারাগঞ্জে নবনির্মিত শেখ রাসেল মিডিয়া সেন্টার, নগরীতে অবস্থিত শেখ রাসেল ইনডোর স্টেডিয়াম, শেখ রাসেল সুইমিংপুল, পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, রংপুর পালিচড়া স্টেডিয়াম, প্রায় ২০ কিলোমিটার নলেয়া ও আলাইকুড়ি নদী খনন কাজ, পীরগাছা উপজেলার চৌধুরানী থেকে শঠিবাড়ি সড়ক, পীরগঞ্জ উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি থেকে খালশপীর সড়ক, রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার জাগিরহাট, পীরগাছা ভায়া বালারহাট সড়কের গোপালগঞ্জ ঘাটে ঘাঘট নদীর ওপর ব্রিজ, রংপুর গংগাচড়া-কাকিনা সড়কে নির্মিত ব্রিজ, রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার তিনতলা পল্লীমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম ফ্লাড সেন্টার নির্মাণ কাজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ মাল্টিপারপাস ভবন, রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের অফিস ভবন, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার হেলেঞ্চা ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার চতড়া ইউনিয়নে ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে ১০ শয্যাবিশিষ্ট বেগম রোকেয়া মডার্ন হাসপাতাল, রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার খালশপীর ইউনিয়নে ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার মাদারগঞ্জে ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, রংপুর সিটি করপোরেশনের ২৯ নং ওয়ার্ডে গ্রাসফন্ট প্ল্যান ও স্টোর ইয়ার্ড নির্মাণ, প্রায় ১২ একরের ভারার দহবিল, পাটোয়া কামরীল পুনঃখনন, ১৯ একরের চিতলী বিল পুনঃখনন, রংপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, রংপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অফিস ভবন ও ১৫ একরের নৈমুল্লা বিল পুনঃখনন কাজ। যে ৪টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন সেগুলো হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, রংপুর জেলা বিটাক কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, বাংলাদেশ কর্ম কমিশন সচিবালয়ের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও লেডিস হোস্টেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর সফরে এসব প্রকল্প ছাড়াও উন্নয়নের জন্য আর কী কী ঘোষণা দিতে পারেন নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, পীরগঞ্জ খালাশপীর কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন, রংপুর মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা, শ্যামপুর চিনিকলসহ বিভাগের বন্ধ চিনিকলগুলো পুনরায় চালু, বিশেষ মেগা প্রকল্প, অর্থনৈতিক জোনসহ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু দিবেন এমনটা আশা করছেন রংপুরবাসী। তারা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে রংপুর অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিনির্ভর ভারী শিল্প স্থাপন, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা, চিকিৎসা, খেলাধুলার সুযোগ তৈরি, শ্যামাসুন্দরী খাল খনন, শিল্প-কলকারখানা স্থাপনসহ নানান স্বপ্ন পূরণের ঘোষণা আসবে।
রাজনীতি ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, রংপুরের মহাসমাবেশ থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, রংপুর-লালমনিরহাট-পাটগ্রাম-বুড়িমারী মহাসড়ক চার লেনে রূপান্তর, রংপুরে আধুনিক রেলওয়ে রেলস্টশন নির্মাণ ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগে পক্ষে একটি বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের কাছে রংপুরের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হয়ে উঠবেন ঈর্ষণীয় উদাহরণ।
রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, তিনি মূলত আগামী বছরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা রংপুর থেকে শুরু করবেন। তাই তাকে বরণ করতে ২০ জুলাই থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, জনসভায় রংপুর বিভাগের আট জেলার ৫৮টি উপজেলা থেকে আট থেকে দশ লাখ মানুষ অংশ নেবে। রংপুর জেলার আট উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রতিটি উপজেলা থেকে কমপক্ষে দশ থেকে পনের হাজার মানুষ আনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এজন্য বাস, ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন বুকিং দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতা জানান, রংপুর অঞ্চলের যারা সংসদ সদস্য আছেন বিশেষ করে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে লোক সমাগমের জন্য। এতে করে বোঝা যাবে তৃণমূলে কার প্রভাব কত।
এছাড়া জনসভা সফল করতে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় বর্ধিত সভা করা হয়েছে। ওই সভায় চার মন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়ার প্রতিদিন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন প্রধানমন্ত্রী জনসভা সফল করতে কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তিস্তাপাড়ের সাধারণ মানুষ এবং তিস্তা নিয়ে যারা আন্দোলন করে আসছেন, তাদের আশা প্রধানমন্ত্রী রংপুরের জনসভায় বহু আকাক্সিক্ষত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো সুখবর নিশ্চয়ই দেবেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে তিস্তাপাড়ের মানুষের পানির জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এক কোটি মানুষ উপকৃত হবে।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ রংপুরে এসেছিলেন ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। এ সময় তিনি রংপুরের পীরগঞ্জ ও তারাগঞ্জে দু’টি নির্বাচনী জনসভা করেছিলেন। সাড়ে চার বছরের বেশি সময় পর তিনি রংপুরে আসছেন। এর আগে ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি রংপুর জিলা স্কুল মাঠে মহাজোটের জনসভায় উন্নয়নের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।