বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশ মিলে ছিটমহল : ‘বঙ্গবন্ধুর হাতে চুক্তি শেখ হাসিনায় মুক্তি’

sitmohol.webp

দেশের তথ্য ডেস্ক :-  বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশ মিলে ১৬২টি ছিটমহলের মোট জমি ২৪ হাজার ২৭০.৮৩ একর। এর মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন সাত হাজার ১১০.২০ একর এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮.৫ একর। রাজনীতির মারপ্যাঁচে এসব ভূমিতে বসবাসকারীরা নিজেদের অজান্তেই ছিটমহল নামের কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েন। এখানকার মানবগোষ্ঠীকে বিনা বিচারে ৬৮ বছর কাটাতে হয়েছে।

১৯৭৪ সালের ‘ল্যান্ডবাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর মধ্যেই ছিল ছিটমহল সমস্যার সমাধানের কথা। এই চুক্তির বাস্তবায়নেই ছিটমহলবাসীর মুক্তি নিহিত ছিল। ১৯৭৪ সালে চুক্তিটি বিধিমতো আমাদের সংসদে রেটিফায়েড করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফলে আমাদের দিক থেকে এর সমাধানে আইনি বাধা আর থাকেনি।

কিন্তু চুক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি মহল বেশ সোচ্চার হয়। তারা জোরেশোরে প্রচারে নামে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি দেশবিরোধী ও দেশ বিক্রির। তারা গোলামির চুক্তিও বলতে থাকল। এই চুক্তিকে ধরে বিশেষ মহলটি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ঘুঁটি চালতে থাকল।
এদের পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তির শক্ত সহযোগিতা ছিল। এরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে। রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে এরা মৃত বঙ্গবন্ধু এবং চুক্তির অপর পক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। মাঠে-ময়দানে সভা-সমাবেশে সমানতালে চুক্তিটির বিরোধিতা করে বক্তব্য দিতে থাকে। তারা ভারতকে বন্ধুর পর্যায় থেকে নামিয়ে শত্রুর খাতায় তালিকাভুক্ত করে।

পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরবসহ অনেক রাষ্ট্রই এ কাজে তাদের পরানের বন্ধু হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত লক্ষ্যগুলোও হাতছাড়া হতে থাকে ক্রমান্বয়ে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১ বছর বিটিভিতে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ ছিলেন। সেখানে ভারতকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা ছিল। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের শত্রু পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলোতে তাঁরা বড়জোর বলতেন হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে কোন রাষ্ট্র হানাদার ছিল সেটি তাঁরা বলতেন না। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। একটি সমাধানযোগ্য মানবিক ইস্যু ছিটমহল আটকে যায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা আর বিষয়টি তাদের সংসদে তোলেনি। যার ফলে বিনিময় বিষয়টি একেবারে থমকে যায়। ফলে ছিটমহলে বন্দিজীবন প্রলম্বিত হয়। যে জীবন থেকে মুক্তি মেলে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে। তারিখ হিসেবে ১ আগস্ট ২০১৫।

এই আগস্টেই বঙ্গবন্ধু ছিটমহল বিনিময়ে বিরুদ্ধে থাকা শক্তির হাতে শাহাদাত বরণ করেন। সে মাসের সূচনায় ছিটমহল বিনিময় করে মানুষের মুক্তি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সরকার। ছিটমহল বিলুপ্তির পর মুক্ত নিঃশ্বাসের যেমন সুযোগ হয়েছে, তেমনি সূচিত হয়েছে মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার। ছিটমহলে মানুষের বেদনার কথা আমরা কমবেশি অবগত, কিন্তু মুক্তির পর তাদের অগ্রগতির বিষয়গুলো তেমনভাবে আলোচিত হচ্ছে না। বেদনার কথা যেভাবে গণমাধ্যমে প্রাধান্য পায় সে পরিমাণে আনন্দ ও উন্নয়নের কথাগুলো প্রচারে আসে না। গত আট বছরে বিলুপ্ত ছিটমহলে যে উন্নয়ন হয়েছে তা নজরকাড়া। মূল ভূখণ্ডের মানুষের কাছেও ঈর্ষণীয়। আজ সেখানকার নাগরিকরা যাবতীয় নাগরিক অধিকারের আওতায় এসেছে।

অথচ ছিটমহল বিনিময়ের আগে নাগরিক অধিকার দূরে থাক, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার স্বাধীনতাটুকুও ছিল না। সেখানে মসজিদ, মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল না। না ছিল পাকা রাস্তা, না ছিল বিদ্যুৎ। পাকা পায়খানায় মলত্যাগ করা যায় এমনটিও কল্পনার বাইরে ছিল।

ছিটমহল ছিল অন্ধকার জগৎ। রাষ্ট্রের প্রতি ইঞ্চি জমিতে সার্বভৌমত্ব থাকে, নাগরিকরা নিয়ন্ত্রণে থাকে রাষ্ট্রের। তেমনটি ছিটমহলে ছিল না। সেখানে প্রকৃতির আলো-বাতাস ছাড়া নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। ফলে এগুলো অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। স্থলভাগের এমন কোনো মানব অপরাধ ছিল না, যেগুলো ছিটমহলে হয়নি। নাগরিকরা অপরাধ না করলে বাইরের রাষ্ট্র থেকে আসা অপরাধীরা জোর করে সেগুলো করত। নিরীহ ছিটমহলবাসীর প্রতিরোধের সুযোগ ছিল না। প্রতিবাদ করলেই বিপদ ছিল। ফলে তাদের আপস করে চলতে হয়েছে।

ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ-ভারত কোনো রাষ্ট্রীয় প্রশাসন দ্বারা শাসিত না হওয়ায় সেখানে নানা রকম অপরাধপ্রবণতা ছিল অনেক বেশি। সেখানে জুয়া, মাদক বেচাকেনা ছাড়াও মানবপাচার, সোনা, মোটরসাইকেল স্মাগলিংয়ের ল্যান্ডিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। দিনদুপুরে নেশাগ্রস্তরা ফেনসিডিলসহ নানা মাদকের খোঁজে সেখানে আসত। সেখানে খুন হয়েছে বিচার হয়নি। মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে বিচার হয়নি। জমি বেদখল হয়েছে বিচার হয়নি। নিজেদের সন্তানদের প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে বাংলাদেশ বা ভারতের কারো নামে পিতৃপরিচয় দিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। বিয়ে দিয়েছে। যাঁর নাম স্কুলের খাতায় তিনি তার পিতা নন। এ ধরনের উদাহরণ অজস্র।

আজ সেই ছিটমহলের মানুষ বিচার পাচ্ছে। নিজ মা-বাবার নামে স্কুলে ভর্তি হতে পারছে। বড় হতে পারছে। জমিজিরাত কেনাবেচা করতে পারছে। জমির রেকর্ড হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিজের নাম। ছিটমহলে শিক্ষা বিকাশে বাংলাদেশ সরকার অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছে। নতুন পাকা ভবন হয়েছে। বিলুপ্ত গারাতি ছিটমহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজমহল উচ্চ বিদ্যালয়। সরকারি বরাদ্দে চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম বিদ্যালয়। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলিম মাদরাসাকে সরকারি করা হয়েছে।

পঞ্চগড়ের বালাপাড়া খাগড়াবাড়ি, বেওলাডাঙা ও দহলা খাগড়াবাড়ি ছিটমহলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সেখানে দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারিও করা হয়েছে—বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় এবং শেখ রাসেল উচ্চ বিদ্যালয়। ছিটমহল আন্দোলনের নেতারা শিক্ষা বিস্তারে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, যার মধ্যে গারাতিতে মফিজার রহমান কলেজ ও দাছিয়ারছড়ায় মইনুল-মোস্তফা কলেজ অন্যতম। এর পাশাপাশি মাদরাসাসহ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, মন্দির, শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে। গারাতিতে নতুন করে দুটি বিষ্ণু মন্দির নির্মিত হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীনদের আধাপাকা বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন। এক গারাতিতেই ৯৮টি বাড়ি হস্তান্তর করা হয়েছে। সেখানে আরো ৪০টি বাড়ি বরাদ্দ আছে। আইটি সেন্টার, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান, পুলিশ ফাঁড়ি চালু হয়েছে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী শুধু পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলো থেকেই ২২ জন নাগরিক বিজিবির চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা ভর্তির জন্য কোটাও পাচ্ছেন। ছিটমহল আন্দোলনের নেতা দাশিয়ারছড়ার গোলাম মোস্তফার পুত্র মাহমুদুল হাসান রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়া শেষ করে এবার ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ঢাকায় ভর্তি না হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে ভর্তি হয়েছেন। পরিচয় লুকিয়ে বাংলাদেশ থেকে ডিগ্রি অর্জন করাদের চাকরিতে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীও যেন অভিন্ন সুবিধা লাভ করে সে জন্য অনেক ছিটমহলে আইসিটি ভবন স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে প্রযুক্তিবিষয়ক জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। রংপুর বিভাগে দুটি আইসিটি ভবন স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পঞ্চগড়ের গারাতিতে, অন্যটি কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ায়। যোগাযোগব্যবস্থায় হয়েছে বিপুল পরিবর্তন। এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে শুধু পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলে ২৭ কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে। সেই সড়কগুলোতে ১২টি বড় ব্রিজ হয়েছে। ছোট ছোট অসংখ্য কালভার্টও হয়েছে। দাশিয়ারছড়ায় একই চিত্র। সেখানে নীলকমল নদের ওপর বড় সেতু হয়েছে। দাশিয়ারছড়ায় এখন প্রবেশ করলে মনে হবে আপনি একটি মডেল শহরে প্রবেশ করেছেন।

স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ছিটমহলগুলোতে অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তারা সারা দেশেই চিকিৎসা নিতে পারে। ছিটমহলবাসী রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এসেছে। গর্ভবতী নারীর পুষ্টি ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শিশু ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ যাবতীয় ভাতাই এখন ছিটমহলগুলোতে চালু হয়েছে। বরং অনেক স্থানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ছিটমহলে এসব কর্মসূচি চলছে। প্রায় শতভাগ পরিবার কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে।

পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোতে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাঁরা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পেলেও ছিটমহল বিনিময় হওয়ার আগে তাঁরা কোনো ভাতা পেতেন না। এখন তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা ভাতার আওতায় এসেছেন। নিজেদের ভূমির স্বাধীনতা না থাকলেও তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন। ছিটমহলের মুক্তির আন্দোলনকেও সংশ্লিষ্টদের বিবেচনার অনুরোধ করি। ছিটমহলের নাগরিকদের ডায়াগনসিস সঠিক ছিল। তাঁরা সত্য উপলব্ধি করে মিছিলের স্লোগান রচনা করেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধুর হাতে চুক্তি শেখ হাসিনায় মুক্তি’। আমি এখনকার পরিবর্তনগুলো দেখে বলি ছিটমহল : নরক থেকে স্বর্গে ফেরা। নোবেলদাতাদের চোখে ছানি না থাকলে ছিটমহলের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কারণে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি শান্তিতে নোবেল পেতেন।

Share this post

PinIt
scroll to top