দেশের তথ্য ডেস্ক :- অবরোধ, সচিবালয়, ইসি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসছে
নির্বাচন পর্যন্ত চলবে সিরিজ কর্মসূচি, আজ মহানগর ও জেলায় জেলায় জনসমাবেশ
বএনপির ৫০০ নেতা আহত, গ্রেপ্তার ১২৪ জন, আসামি সহস্রাধিক
গয়েশ্বর ও আমানে সরকারের ইতিবাচকে সুবাতাস দেখছেন বিশ্লেষকরা
গত ১৮ জুলাই ঢাকায় বিএনপির এক দফার প্রথম কর্মসূচি ‘পদযাত্রার’ মাধ্যমে রাজনীতিতে সংঘাতের যাত্রা শুরু হয়। এরপর কয়েকটি কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হলেও গত পরশু ঢাকায় প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ভয়ঙ্কর সহিংসতায় রূপ নেয়। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি স্থানে বিএনপির সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বুলেটপ্রুফ গাড়িতে হামলা করলে পুলিশও পিছু হটতে বাধ্য হয়। এক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও যুক্ত হলে ত্রিমুখী লড়াই রক্তক্ষরণে রূপ নেয়। আতঙ্ক তৈরি হয় পুরো রাজধানীজুড়ে। ছয়টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন বলে দাবি দলটির। পুলিশের ৭০ জন রক্তাক্ত হয়ে পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ ছাড়া পুলিশের টিয়ারশেলে অন্তত ৩০ জন সাংবাদিক আহত হয়। সংঘাতের খবরে বিশ্বগণমাধ্যমে ঢাকা ছিল টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। দেশের রাজনৈতিক মহল বলছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে সংঘাতের দিকে চলে গেছে বিষয়টি স্পষ্ট। বিএনপি-আওয়ামী লীগ কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপি রাজপথে থাকবে। পুলিশ বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যদি বাধা দেয় তারাও রাজপথে লড়বেন বলে জানায় দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র। বিএনপির হাইকমান্ড বলছে, আজ (সোমবার) থেকে নির্বাচন পর্যন্ত তাদের সিরিজ কর্মসূচি চলবে। কোনো ধরনের বিরতি দেয়া হবে না। বাধা এলে ছাড়ও দেয়া হবে না। শনিবারের মতোই লড়াই করা হবে।
সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে রাজপথ-রেলপথ অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাও, নির্বাচন কমিশনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি নোটে রয়েছে। পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে তা ঘোষণা করা হবে। সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যদি হার্ডলাইনে থাকে তাহলে তারা আরও হার্ড কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি আপাতত চিন্তা না করলেও সরকার যদি কর্মসূচিতে বাধা তৈরি করে বিএনপি সেই পথেও হাঁটতে বাধ্য হবে বলে দাবি দলটির। অতীতে বিএনপি বড় বড় কর্মসূচিগুলো ঢাকার বাইরে সফল হলেও এবার তাদের প্রধান টার্গেট ঢাকা। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আগামী মাসে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে দলটি এমন চিন্তাও রয়েছে। ঢাকার অবস্থান কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় আজ সোমবার মহানগরগুলোতে ও জেলায় জেলায় জনসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি।
শনিবার রাতে এই কর্মসূচি ঘোষণার দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকার মহাসমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রকাশ্যে বলেছেন, যারা জেলা শহর থেকে ঢাকায় এসেছেন তারা কেউ আর বাড়ি ফিরে যাবেন না। ধাপে ধাপে বিএনপির কর্মসূচি আসবে। ঢাকায় সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এই সরকারের পতন পর্যন্ত আপনাদের ঢাকায় থাকতে হবে। জানা গেছে যারা মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় এসেছে তাদের বড় অংশই নির্বাচন পর্যন্ত থাকতে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, বিএনপির অনেক নেতাকর্মী কম্বল বালিশ নিয়ে ঢাকায় ঢুকেছেন। ঢাকার কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৃণমূলের পরীক্ষিত কয়েক হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় অবস্থান করবে বলেও বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি।
জানা গেছে, বিএনপির পূর্বপ্রস্তুতির মাধ্যমে গত শনিবার ঢাকার পাঁচটি জায়গায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। চারটি প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ছিল তাদের। ধোলাইখালে দুই পক্ষের সংঘর্ষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আহত হন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে পুলিশ। একপর্যায়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। সে অবস্থায়ও তাকে লাঠিপেটা করা হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে নেয়া হয়। সেখানে ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ সোনারগাঁও থেকে খাবার এনে মধ্যাহ্নভোজ করান। পুলিশের মাধ্যমে সেই ছবি ভাইরাল হয়। পরে ডিবির গাড়িতেই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া গাবতলীতে বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ তাদের সরে যেতে বললে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান জায়গা ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ ও পুলিশের তর্কাতর্কি হয়। এর মধ্যে আ.লীগের নেতাকর্মীরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে স্লোগান দেয়। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে ফল ও খাবার পাঠানো হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনার মাধ্যমে রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে। এতদিন বিএনপি রাজপথে নামতে পারে না বলে আওয়ামী লীগ মন্তব্য করলেও সেটি আর বলার সুযোগ থাকবে না। বিএনপি রাজপথে শক্তি দেখানোর পর সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক আচরণ করায় অবশ্যই ভালো লক্ষণ বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বিএনপি আন্দোলন যাত্রায় সফল এটি বলা চলে। সামনে বিএনপির আরও পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার আরো ইতিবাচক হবে বলেও মনে করা হচ্ছে। যদিও এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুরোনো পদক্ষেপ দেখা গেছে। বিএনপির দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৫০০ জন আহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১২৪ জন। গত ১৯ মে ২৯ জুলাই অদ্যাবধি বিএনপির নামে ৩২০টি মামলা দেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৫১৪ জন। মোট আসামি করা হয়েছে প্রায় এক হাজার ৪৫০-এর অধিক নেতাকর্মীকে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘সভা-সমাবেশ করা আমাদের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এত দিন যেভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিলাম আমরা, সেই ধারাতেই রয়েছি। গত শনিবার ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথে আমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে তারা (সরকার) পুলিশ দিয়ে আক্রমণ করেছে। ক্ষমতাসীনরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। বাস জ্বালিয়ে দেয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি কে করেছে, এই চিত্র তো সবার সামনে পরিষ্কার। পুলিশের সামনে বাসে আগুন লাগাচ্ছে। তারপর ছবি তুলছে। ভিডিও করছে। এরপর তাদের সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছে। পুলিশের সামনে এসব করলেও একটা লোককেও ধরা হলো না। পুলিশের সামনে যারা আগুন দেয়, ভিডিও করে, তারা কে, এটি বুঝতে তো অসুবিধা হয় না। এ কাজগুলো তারা বিগত দিনেও করেছে। আমরা আন্দোলন করছি। আমাদের আন্দোলন সরকার পতন পর্যন্ত চলবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোহরাব হাসান এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন। সরকারকে বুঝতে হবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমস্যাটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। আইনশৃঙ্খলাজনিত নয়। আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা পুলিশ-র্যাব-বিজিবি দিয়ে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। তারা বুঝতে পারছেন না নির্বাচনের বিষয়ে দুই দলের বিপরীত অবস্থান দেশকে মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেভাবে সংঘাত হচ্ছে এটি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এসব কর্মসূচি ভয়াবহ ঝুঁকির সৃষ্টি করে। বস্তুত শনিবার সহিংসতা হয়েছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। অনেক ব্যক্তির আহত হয়েছেন, গ্রেপ্তারও হয়েছেন। বিরোধী দলগুলো যদি শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত তাদের কর্মসূচি পালন করতে দেয়া। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, সমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি আমাদের মৌলিক অধিকার। এগুলো সংবিধান কর্তৃক সংরক্ষিত। এসব মৌলিক অধিকার পালনে পুলিশের অনুমতি লাগবে, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে অবশ্যই পুলিশের দায়িত্ব রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় এমন কার্যক্রম তৈরির শঙ্কা থাকলে বা ঘটলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা। পুলিশের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, যেখানে কোনো ধরনের সংঘর্ষ বা সংঘাত হবে না, সেটি কাম্য নয়। পুলিশের অনুমতি নিয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়। তবে দুই দলকেই সহিংসতা পরিহার করতে হবে।