কয়লা সংকটে সাত মাসে পাঁচবার বন্ধ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

RAMPAL-20230730183307.jpg

দেশের তথ্য ডেস্ক রামপাল প্রতিনিধি :- 

প্রভাব ফেলবে জাতীয় গ্রিডে
বারবার বন্ধে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা
দ্বিতীয় ইউনিট নিয়েও শঙ্কা
আগে চার দফায় ৫৩ দিন বন্ধ ছিল
ডলার সংকটে বারবার হোঁচট খাচ্ছে কেন্দ্রটি
৮ আগস্ট ফের চালু হওয়ার আশা
প্রতিদিন প্রয়োজন পাঁচ হাজার টন কয়লা
বন্ধেও গুনতে হবে ক্যাপাসিটি চার্জ
৮ আগস্ট কয়লা দেশে এসে পৌঁছালে ফের উৎপানে যাবে
—আনোয়ারুল আজিম, উপমহাব্যবস্থাপক
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

কয়লার মজুত না থাকায় বারবার বন্ধ হচ্ছে উৎপাদন
—ওয়াজেদ আলী সরদার
সদস্য (উৎপাদন), পিডিবি

আলোচিত-সমালোচিত রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লার অভাবে ফের বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদনে যাওয়ার সাত মাসে পাঁচবার বন্ধ হয়েছে কেন্দ্রটি। বারবার কয়লা সংকটে এমন ঘটনায় উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে টারবাইন (বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্র) ত্রুটির কারণে গত ১৬ জুলাই বন্ধ হয়ে যায় রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। টারবাইন মেরামত শেষে ২০ জুলাই দুপুর থেকে পুনরায় উৎপাদন শুরু হয়। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর কখনও কয়লার ঘাটতি কখনও-বা কারিগরি ত্রুটির কারণে পাঁচবার উৎপাদন বন্ধ হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। উৎপাদন শুরুর পর প্রথম ১৪ জানুয়ারি, এরপর ১৫ এপ্রিল, ২৩ এপ্রিল, ৩০ জুন ও ১৬ জুলাই বন্ধ হয় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। সব মিলিয়ে চার দফায় কেন্দ্রটিতে ৫৩ দিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। ফলে এই দিনগুলোতে কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ বন্ধ ছিল।

বারবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সচেতন মহল। চলমান বিদ্যুতের ঘাটতির সময়ে ফের এমন ঘটনায় বিরাট প্রভাব পড়ছে জাতীয় গ্রিডে।
সর্বশেষ গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) উপমহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজীম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় আবারও উৎপাদনে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে ডলার সংকট অব্যাহত থাকায় কয়লা আমদানি অব্যাহত রাখা যাবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় পুরোপুরি কাটেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর হয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করা কঠিন। আমদানি করতে পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে নয়ত উৎপাদন বন্ধ থাকবে। ফলে বিদ্যুৎ বিভাগকে বারবার বিপদে পড়তে হচ্ছে। ফলে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে সাধারণ জনগণকে।

কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর উৎপাদনে যাওয়ার ২০-২২ দিন পরই আমদানি করা কয়লার স্বাভাবিক মজুত শেষ হয়ে যায়। ডলার সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় রিজার্ভ কয়লা দিয়ে আরও পাঁচ দিন উৎপাদন চালু রাখা হয়। পরে রিজার্ভ কয়লার মজুত শেষ হয়ে গেলে ৪ জানুয়ারি সকালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর মাত্র ২৭ দিনের মাথায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক হলে এক মাসের মাথায় আবার উৎপাদনে ফেরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ডলারের অভাবে ঋণপত্র খুলতে না পারার কারণেই বারবার সংকটে পড়ছে রামপাল।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, নিয়মিত ৫৬০ থেকে ৫৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছিল রামপাল কেন্দ্র। উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ৪৬০ মেগাওয়াট ঢাকার জাতীয় গ্রিডে এবং ২০০ মেগাওয়াট খুলনা-বাগেরহাটে সরবরাহ করা হচ্ছিল। নিয়মিত উৎপাদনের জন্য কেন্দ্রটিতে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন। কয়লা আসত ইন্দোনেশিয়া থেকে। এছাড়া দ্বিতীয় ইউনিটের কাজও প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে তখন প্রতিদিন কয়লা প্রয়োজন হবে ১০ হাজার টন। যেখানে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টনের জোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা সরবরাহ সম্ভব হবে বলে মনে করছেন স্বয়ং কেন্দ্র সংশ্লিষ্টরাই।

বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জেলায় পিক আওয়ারে ৯৪ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ থাকছে ৫৫ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। অপরদিকে অফপিকে ৮০ থেকে ৮২ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ আসছে ৪৫ থেকে ৫০ মেগাওয়াট। এদিকে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এই সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণ কাজে। কারণ চুক্তি অনুযায়ী, রামপালের বিদ্যুৎ পিডিবিকে কিনতে হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ থাকলেও পিডিবিকে কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যয় বা ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) দিতে হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ওজোপাডিকোর মোংলা অঞ্চলের এক কর্মকর্তা বলেন, উৎপাদনে আসার পর থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে খুলনাসহ এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে কেন্দ্রটিকে। ফলে বাড়বে বিদ্যুৎ বিপর্যয়।

এ বিষয়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিজিএম আনোয়ারুল আজিম বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে কয়লা চলে আসবে। তখন আবার উৎপাদন শুরু হবে। তবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে যে পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন সেটার সরবরাহ সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। ডলার সংকটের মধ্যে কয়লার আমদানি সামনের দিনগুলোয় চলমান থাকবেন কিনা সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তিনি আরও বলেন, কয়লা আমদানির জন্য সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনরায় কবে উৎপাদনে আসবে জানতে চাইলে বিপিডিবি পরিচালক (জনসংযোগ) শামীম হাসান বলেন, আগামী মাসের ৮ তারিখের দিকে রামপাল পুনরায় উৎপাদনে আসার সম্ভাবনা আছে। ৫৫ হাজার টন কয়লার একটি জাহাজের জন্য ইতোমধ্যে ঋণপত্র খোলার প্রক্রিয়া চালু আছে। ৮ আগস্টের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনরায় চালু করা যাবে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ কয়লার মজুত নেই। ফলে বারবার বন্ধ হচ্ছে উৎপাদন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বিনিয়োগে বাগেরহাটের রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। কেন্দ্রটিতে মোট দুটি ইউনিট রয়েছে, যার প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট করে। সে হিসাবে কেন্দ্রটির পূর্ণ সক্ষমতা হলো দৈনিক ১৩২০ মেগাওয়াট।

Share this post

PinIt
scroll to top