দেশের তথ্য ডেস্ক ঢাকা প্রতিনিধি :- তারেক রহমান, মির্জা ফখরুল ও মোশাররফ তলে তলে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে খালেদা জিয়া, গয়েশ্বর রিজভীরা চান আন্দোলন —নির্বাচন নয়।।
একাদশে ড. কামালকে নিয়ে সময়ক্ষেপণ, দ্বাদশে ৩৬ দল নিয়ে
পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ২২ মামলায় আসামি ১৫ হাজার, নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে
১০ দফা, ২৭ দফা, ৩১ রূপরেখা ও সর্বশেষ এক দফা, বারবার দফা ঘোষণায় তৃণমূলে বিরক্ত
ভোট আসলে বিএনপির আন্দোলনের গতি বাড়ে। আবারও পুরোনো দৃশ্য দলটিতে। অন্য কোনো বড় ইস্যুতেই সরব নয় বিএনপি! খালেদা জিয়ার বন্দিদশায় দোয়া-মিলাদ ও কয়েকটি সমাবেশে করেই সময় পার। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের দুর্নীতি, শেয়ার বাজার লুট, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, রিজার্ভ ধস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়নি। এ নিয়ে আসেনি একক কোনো কর্মসূচিও। একাদশ সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে সমাবেশ ও সংলাপ করে সময়ক্ষেপণ করেছে। বন্দি খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে গিয়ে ভরাডুবি হয়েছে। ছয় সংসদ সদস্যকে নিয়ে সংসদেই গিয়েছে। এবার বর্ষাকাল এবং এসএসসি পরিক্ষাকে সামনে রেখে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
তবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ভীত নয়। দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে অতীতের মতো কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও গেলো বছর বিএনপির আন্দোলনের যৌবন সময় পার হয়েছে। তখন তারা সেই ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। আন্দোলনের জন্য অপেক্ষা করেছে নির্বাচন সময় পর্যন্ত। আবার দলের একাংশ বিদেশিদের দিকেও দৃষ্টি দেন। শেষ বেলায় এসে কূটনৈতিক মিশনও বলেছে, তারা সংঘাত সহিংসতা চায় না। এ জন্য বিএনপিও হরতাল অবরোধের মতো বড় কর্মসূচি থেকে পিছু হটে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির পথেই হাঁটছে। এবারও অতীতের মতো পার হবে নির্বাচনি সময়। ঐক্যফ্রন্টের মতো গণতন্ত্র মঞ্চ ও ৩৬ দল নিয়ে চলছে পুরোনো ফর্মেটে কর্মসূচি। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, একাংশ চাচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা নিয়ে আগামী নির্বাচনেও অংশ গ্রহণ করতে। এ অংশে রয়েছে তারেক রহমান, মির্জা ফখরুল ও খোন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ আরো অনেকে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া,গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভীসহ একাংশ কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে নয়। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পরিবর্তন চাচ্ছেন সাবেক তিনবারের প্রদানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
২০২১-এর অক্টোবর থেকে পর পর চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও রাজশাহীর গণসমাবেশগুলো হয়েছিল অত্যন্ত সফল ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী। পথে পথে পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মীদের বাধা, হামলা উপেক্ষা করে সমাবেশগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা এসেছিল মোটরসাইকেল, বাইসাইকেলে, নৌকায়, পায়ে হেঁটে, চিড়া-মুড়ি সঙ্গে নিয়ে। আগের রাতে পৌঁছে মাঠ ভরিয়ে দিয়ে সেখানে শীতের রাত যাপান করেছে তারা। গত ১০-১২ বছরে হাজার হাজার মামলা ও গ্রেপ্তারে পর্যুদস্ত অবস্থায়ও দলটির সমর্থক সংখ্যা কমেনি এবং নানারকম চাপ ও প্রলোভন দলটিতে ভাঙন ধরেনি তা প্রমাণিত হয়েছে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বোঝা গিয়েছিল সংগঠিত কর্মীবাহিনীর বাইরের দলীয় সমর্থকরা সক্রিয় হতে শুরু করেছে। রাজনীতিতে দুঃসময়ে নেতৃত্বের আহ্বানে প্রথম এগিয়ে আসে ত্যাগে ব্রতী ও ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত সংগঠিত নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। তখন বিএনপির আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। গণঅভ্যুত্থান হওয়ার মতো দৃশ্যপট তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষও সেই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিল।
কিন্তু অদৃশ্যকারণে ঢাকার কর্মসূচি সফল হয়নি। ১০ ডিসেম্বরের তিন দিন আগ থেকেই নয়াপল্টনে অবস্থান নিয়ে গানবাজনা শুরু করা হয়। খিচুড়ি তৈরি করে নেতাকর্মীদের বিলি করা হয়। একপর্যায় পুলিশ পল্টন এলাকা নিজেদের দখলে নেয়। দলের মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় সব নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। এক পর্যায় সরকার রাজধানীর গোলাপবাগের মাঠ বিএনপির জন্য ঠিক করে দেয়া হয়। সরকার দেখানো পথেই হাঁটতে হয় দলটিকে। ওই সমাবেশ থেকে সরকার পতনে দেয়া হয় ১০ দফার ঘোষণা। তাদের সাত সংসদ সদস্যদেরও পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর আন্দোলনের শীতল ছায়া শুরু হয়। কিছুদিন পর ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্র সংস্কারে ২৭ দফা। এরপর ঘোষণা করা হয় যুগপৎ কর্মসূচির ৩৬ দলের ৩১ রূপরেখা। তারপর দেয়া হয় সরকার পতনের এক দফা। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য কী? সরকারের পতন ঘটানো, না দেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান? নির্বাচনের আগেই যদি সরকারকে পদত্যাগ করতে হয় বা তার পতন ঘটাতে হয় তাহলে নির্বাচনের দরকার কি?
এদিকে বিএনপির নতুন ধাপের আন্দোলনে ভালো সময় যাচ্ছে না। ঢাকায় ১৮-১৯ জুলাই গাবতলী-যাত্রাবাড়ী ১৬ কিলোমিটার ও আবদুল্লাহপুর-বাহাদুরশাহ পার্ক ৩৭ কিলোমিটার যে দুটি পদযাত্রার কর্মসূচি দেয়া হয় তা কর্মীদের ক্লান্ত করে। মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সারা দেশেও সংঘর্ষে শতশত নেতাকর্মী আহত হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে সজীব নামে এক দলীয় কর্মী নিহত হয়। এ ছাড়া পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৫ হাজার মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় দলটির ১২৫ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অনেকেই এখন বাড়ি ছাড়া। রয়েছে আত্মগোপনে। ঢাকায় দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিএনপির নেতাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। শনিবার তারুণ্যে সমাবেশ শেষে নবাবগঞ্জের বাড়িতে ফেরার সময় হামলা আহত হয়েছেন ছাত্রদলের এক নেতা। তার নাম সাব্বির আলম। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি এই ছাত্রদল নেতার মাথায় ৪০টি সেলাই দেয়া হয়েছে। সাব্বির সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্রদল নেতা এবং ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। গতকাল রোববার তাকে দেখতে যান ঢাকা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খন্দকার আবু আশফাক, সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী ও ঢাকা জেলা যুবদল সভাপতি রেজাউল করিম পল। সাব্বির অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা মোয়াজ্জেমের ভাতিজা সুমন শিকদার ও মুন্নার নেতৃত্ব এ হামলা হয়। তারা আমাকে রড দিয়ে আঘাত করে। মুন্না কিরিচ দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে।
এ ছাড়া সরকার পতনের দাবিতে এবার ঢাকায় ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। একই দিন যুগপৎভাবে মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরামসহ ৩৬টি রাজনৈতিক দল ও জোট। বিএনপি এই অল্প সময়ের মধ্যে আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলা নিয়ে স্বয়ং নিজেদের মধ্যেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিএনপির এক নীতি নির্ধারণী ব্যাক্তির ভাষ্য, ২০২২ সালে বিএনপির আন্দোলন নস্যাৎ হওয়ার পেছনে দলীয় হাইকমান্ডের হাত রয়েছে। সব কৌশল সরকারের ঘরে চলে গিয়েছে কিছুই গোপন থাকেনি। বিএনপির তরি তীরে আসলেও তার ফলাফল ঘরে তোলা যায়নি। এখন দফা নিয়ে দাবি নিয়ে সরকারকে চাপ দেয়া সম্ভব হবে বলেও মনে হচ্ছে না। ইতোমধ্যে সরকার মাঠ প্রশাসন সাজিয়ে ফেলেছে, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলেছে। যা করার তাই করে ফেলেছে। বিদেশি কোনো চাপেও সরকার মাথা নত করছে না। সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল।
জানতে চাইলে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু আমার সংবাদকে বলেন, আমরা শপথ করছি, শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত, চার কোটি ৭০ লাখ তরুণ ভোটারের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত, বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত না করা পর্যন্ত রাজপথ ছেড়ে যাব না। আমরা আন্দোলন করব। আমাদের আরো কর্মসূচি আসবে। সরকারের পতন নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমার সংবাদকে বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া এবার এই দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আমরাসহ ৩৬টি দল যুগপৎভাবে ঘোষণা দিয়েছি, সবাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন চাই। সে জন্য অবিলম্বে শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। শুধু বিএনপি নয়, জাতীয় পার্টি ও চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলনও পরিষ্কার করে বলেছে, এই সরকারে অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও বলেছে, অন্যান্য দলও বলেছে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই কালবিলম্ব না করে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ফয়সালা এবার রাজপথে হবে।